সাঈদ মাহমুদ আলী রেজা: বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে নামকরন প্রথা বা নেইমিং কনভেনশন এবং আমদের প্রেক্ষাপটঃ
(২য় পর্ব)
নামকরন প্রথা বা নেইমিং কনভেনশন নিয়ে আমাদের দেশের প্রসংগে আসি…
সম্ভবত আমরা বাংলাদেশিরা খুব অল্প কিছু জাতি গোষ্ঠির একটি যাদের কোন নেইমিং কনভেনশন নেই। ইচ্ছে মতো নাম রাখি আমরা। নিয়ম কানুনের বালাই নেই।
আমাদের সমাজে যুগ যুগ ধরে যেটা চলে আসছে সেটা হলো, প্রতিজনের দুটো করে নাম থাকে। ভালো নাম ও ডাক নাম। বাঙালী মুসলমানদের বংশগত নামের প্রচলন প্রায় উঠে গেছে বললেই চলে।
১. ভালো নামঃ ভালোনামটি প্রধানতঃ কাগজে কলমে, নথিপত্রের কাজে ব্যবহারের জন্য। এছাড়া ফর্মাল সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভালো নামের একটি অংশ বা পুরো অংশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
২. ডাকনামঃ এটি ব্যবহৃত হয় পরিচিত মহলে, বন্ধুবান্ধব পরিবার ও আত্মীয় স্বজনদের মাঝে। কোন দাফতরিক কাজে সাধারনত এর ব্যবহার নেই।
অবশ্য অনেকের ক্ষেত্রে ভালো নামের একটি অংশ ডাক নাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমনঃ মোঃ এহসান এর ডাক নাম এহসান। মোঃ আব্দুস সালামের ডাক নাম হয়তো সালাম।
৩. বংশগত নামঃ ২/৩ পুরুষ আগেও মুসলমান সম্প্রদায় সাধারনত নামের শেষ অংশে বংশের নাম ব্যবহার করতো। যেমন চৌধুরী, প্রামানিক, মন্ডল, পাটোয়ারী, বিশ্বাস, ভুঁইয়া ইত্যাদি। ইদানীং নামের সাথে বংশগত নাম রাখার প্রচলন প্রায়ই উঠে গেছে। যদিও হিন্দু সম্প্রদায়ে শেষ অংশে বর্ণ বা কাস্ট উল্লেখ থাকে। যেমনঃ চক্রবর্তী, অধিকারী, শীল, দাস, কর্মকার, সেন, ভট্টাচার্য্য ইত্যাদি।
আমাদের নামকরনের সমস্যাঃ
১. আমাদের সুনির্দিষ্ট নামকরন প্রথা না থাকায় সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে হয় দেশের বাইরে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে। মোঃ আব্দুল করিমের পুত্র মোঃ বাসেত মিয়াকে যখন মধ্যপ্রাচ্যের ইমিগ্রেশন পার হতে হয়, মোহাম্মদ বাসেত মিয়ার ঘাম ছুটে যায় অফিসারকে বিশ্বাস করাতে, যে সত্যি সত্যিই তার বাবা মোঃ আব্দুল করিম। কারন নিয়মানুসারে First name যদি মোহাম্মদ হয়, সেটাই মোহাম্মদ বাসেত মিয়ার প্রদত্ত নাম (আমাদের ভাষায় ডাক নাম) আর বাসেত তার বাবার নাম হবার কথা। আর বাবার Surname এর ঘরে লেখা করিম আর ছেলের Surname এর ঘরে লেখা মিয়া। (তাদের দৃষ্টিতে) এটা কিভাবে সম্ভব??
অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও একই অবস্থা। ধরুন এক কোম্পানীতে তিনজন বাংলাদেশি কাজ করেন। তারা মোঃ আলতাফ মিয়া, মোঃ রহিম বখশ এবং মোঃ আব্দুল করিম। এদের প্রত্যককেই তারা মোহাম্মদ ডাকবে। নিশ্চয়ই তিন জনের জন্যও সেটা বিব্রতকর। ওরা বলতেই পারে, তোমাদের দেশে মোহাম্মদ ছাড়া কি আর নাম নেই?? নামের একটি সুনির্দিষ্ট প্রথা থাকলে আমাদের এই সমস্যার সৃষ্টি হতো না। আরেকটি মজার ব্যপার হলো, নামের আগে Md. লেখা দেখে অনেক বাংলাদেশীকেই পশ্চিমা দেশে মনে করা হয় সে হয়তোবা MD ডিগ্রীধারী।
২. আমাদের বড় একটি সমস্যা নামের আগে মোহাম্মদ ব্যবহার করা। আমাদের একটা মারাত্মক ভুল ধারনা আছে মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানেই নামের আগে মোহাম্মদ থাকতে হবে। ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী একটি সুন্দর অর্থবহ ইসলামিক নাম থাকতে হবে, তার মানে এই নয় সবার নামের আগে মোহাম্মদ থাকা আবশ্যকীয়। অনেকের ক্ষেত্রে আলহাজ্ব ও নামের অংশ হয়ে যায়। আমার একটি ছোট্ট প্রশ্ন, চার খলিফা সহ কয়জন সাহাবা কেরাম, তাবেঈ বা তাবেঈন এর নাম মোহাম্মদ দিয়ে শুরু? কিংবা আমরা কি উনাদের নামের পুর্বে আলহাজ্ব ব্যবহার করি? বিশ্বের অপরাপর মুসলিম দেশ গুলোতে এই প্রচলন নেই।
৩. ধরা যাক কারো নাম মোহাম্মদ আব্দুল জব্বার। পাসপোর্ট পুরন করার সময় সাধারনতঃ Given name এর জায়গায় লেখা হয় Md. বা Mohammad, এরপর Middle name এর জায়গায় লেখা হয় Abdul এবং Surname এর জায়গায় লেখা হয় Jobbar. উনার Surname বা বংশগত নাম কি Jobbar? সত্যিকার অর্থে এই জব্বার সাহেবের পুরো নামটাই আসলে Given name. মো: আব্দুল জব্বার একটি উদাহরন মাত্র, আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীর প্রায় সকলেরই একই অবস্থা।
৪. ইদানীং সুন্দর দুটো নাম একত্র করে আমরা বাচ্চাদের নাম রাখি। শুনতে খুব সুন্দর শোনালেও আসলে সেখানেও বিভ্রাট। শাহরিয়ার নাফিস, ইমতিয়াজ ফারুক, আনিকা নাওয়ার, জায়েদ ইকবাল, মাহজাবীন আঞ্জুম ইত্যাদি সব বাহারী নাম। ইমতিয়াজ ফারুককে প্রশ্ন করতে হয়, ভাই আপনাকে ইমতিয়াজ নামে ডাকবো নাকি ফারুক নামে ডাকবো? ইমতিয়াজ ফারুক হয়তো নিজেই জানেন না এই প্রশ্নের উত্তর। তাই কোথাও হয়তো উনি ইমতিয়াজ, কোথাওবা ফারুক আর ইমতিয়াজ ফারুকের ডাকনাম সুমন হলে বাসায় বা পাড়ায় বা প্রিয়জনদের কাছে সুমন।
আয়ারল্যান্ডের ডেনিয়েল হেগিন্স কিন্তু সব জায়গাতেই ডেনিয়েল। যদিও সম্মান করে তাকে মি. হিগিন্সও বলা হয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে তাকে ভিন্ন নামে ডাকা হতে পারে কিন্তু সবাই জানে তাকে কোথায় কিভাবে ডাকতে হবে। এই প্রশ্ন তাকে কখনো করার প্রয়োজন পড়ে না, তোমাকে ডেনিয়েল নাকি হিগিন্স নামে ডাকবো?
আমাদের দেশের নামকরন প্রথা বা নেইমিং কনভেনশন নিয়ে ব্যক্তিগত প্রস্তাবনাঃ
১. নামকরনের বিষয়ে অবশ্যই আমাদের একটা নিয়মনীতিতে আসতে হবে। আসতেই হবে। সরকারকে এ ব্যপারে এগিয়ে আসতে হবে। তবে জনসচেতনতাটা ভীষন গুরুত্বপূর্ণ।
২. নামের শুরুতে মোহাম্মদ/মোঃ/Md রাখার প্রচলন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
যার নামের শুরু মোহাম্মদ দিয়ে, তার Given name/First name বা ডাক নাম হবে মোহাম্মদ। সেক্ষেত্রে Md. কোনভাবেই লেখা যাবে না, বিশেষতঃ পাসপোর্টে।
৩. কিভাবে হতে পারে নামকরনঃ (ব্যক্তিগত প্রস্তাবনা)
i) ছেলেদের নামের ক্ষেত্রেঃ
যেহেতু আমাদের দেশে মুসলমান সম্প্রদায়ের মাঝে ইদানীং আর বংশের কোন বালাই নেই, কাজে আমাদের জন্য উত্তম এবং সহজ পদ্ধতিটি হবে মধ্যপ্রাচ্যের নেইমিং কনভেনশন ফলো করা। অর্থাৎ নামের প্রথম অংশ হবে নিজ নাম/ Given name এবং ২য় অংশ/ Middle name বাবার নাম। ৩য় অংশ/ Surname এ থাকবে বংশগত নাম।
যেমন বুলবুল আলমের সন্তানের নাম যদি ইমতিয়াজ রাখা হয়, তবে ইমতিয়াজের নামের প্রথম ও দ্বিতীয়াংশ হবে ইমতিয়াজ বুলবুল। ইমতিয়াজের সন্তান যদি হয় নাফিস, তবে নাফিসের ক্ষেত্রে নাফিস ইমতিয়াজ। নামের প্রথম অংশটি অর্থাৎ নাফিস হবে তার ডাক নাম।
ii) মেয়েদের নামের ক্ষেত্রেঃ ধরা যাক মেয়ের নাম রাখা হলো শামীমা। বাবার নাম ইমরোজ হোসেন। এক্ষেত্রে মেয়ের নামের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ মিলিয়ে তার নাম হতে পারে শামীমা ইমরোজ। এক্ষেত্রে ডাক নাম বা Given name হবে শামীমা। বিয়ের পরে মেয়েদের নাম পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই।
iii) সমস্যা হলো Surname বংশগত নাম নিয়ে। এর সমাধানটি কঠিন। এক্ষেত্রে আমরা পুর্ব পুরুষদের বংশ খুঁজে বের করতে পারি। অথবা বাবা বা দাদার নামের শেষ অংশটিকে Surname বা বংশগত নাম হিসেবে ব্যবহার করতে পারি। যেমন নাফিস ইমতিয়াজ এর বংশগত নাম দাদার নামের ‘বুলবুল আলম’ থেকে আলম আসতে পারে। কাজেই নাফিসের পুরো নাম হতে পারে ‘নাফিস ইমতিয়াজ আলম’। আলম অংশটুকু বংশ পরম্পরায় চলতে থাকবে। তেমনিভাবে শামীমার পুরো নাম হতে পারে ‘শামীমা ইমরোজ হোসেন’।
অর্থাৎ সুনির্দিষ্টভাবে বংশ না পাওয়া গেলে বাবা বা দাদার নামের শেষ অংশ (আলম, হক, হোসেন, উদ্দীন) অথবা যেকোন অংশকে Surname হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। শুরু হোক না নতুন একটা বংশের গোড়াপত্তন, যেই Surname ওই পরিবারের উত্তর পুরুষরা ব্যবহার করবে যুগের পর যুগ, বা শতাব্দীর পর শতাব্দী!! আমাদের কোন একটা জায়গা থেকে শুরুটা তো করতে হবে।
নেইমিং কনভেনশন চালু থাকলে কি সুবিধাঃ
১. আমাদের জাতির নিজস্ব একটি নেইমিং কনভেনশন বা নামকরন প্রথা থাকবে।
২. নাম নিয়ে বিভ্রাট বন্ধ হবে, দেশে বা বিদেশে।
৩. নাম সংক্রান্ত সরকারী কাজ, দলিল দস্তাবেজ ইত্যাদির কাজ নিঃসন্দেহে সহজ হবে। নাম বলেন দলানো নিয়ে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতি কমে যাবে।
৪. বাবার নাম কি বা ডাক নাম কি, ভালো নাম কি, এইসব প্রশ্নগুলো অবান্তর হয়ে যাবে, কেননা কারো নামের সাথেই স্বয়ংক্রিয় ভাবেই তার ডাক নাম ও বাবার নাম চলে আসবে।
৫. ‘ইমতিয়াজ ফারুক’ বা শাহরিয়ার নাফিসের নাম একেক জায়গায় একেক রকম হবে না, বা এমন প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না, ভাই আপনাকে ইমতিয়াজ নাকি ফারুক নামে ডাকবো?
এগুলো কেবলই ব্যক্তিগত প্রস্তাবনা। এরচেয়ে অনেক অনেক উত্তম প্রস্তাবনা আসতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, এটাকে আমলে নিয়ে কাজটি শুরু করা।
করনীয় কি?
১.সরকারকে সুনির্দিষ্ট নেইমিং কনভেনশন বা জাতির নামকরন প্রথা ঘোষনা দিতে হবে।
২. সামাজিক সচেতনতা তৈরী করতে হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদিতে ব্যাপক প্রচারনা করা যেতে পারে।
৩. সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে পারে।
বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি দেশে কোন কিছুই রাতারাতি সম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের জাতীয় প্রয়োজনেই একটি সুনির্দিষ্ট নামকরন প্রথা বা Naming Convention থাকা অত্যন্ত জরুরী। এটি সময়ের দাবী। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যপক প্রচারনার উদ্যোগ নিলে, সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসলে সর্বোপরি সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে, এটিকে বাস্তবে রূপ দেয়া কেবল সময়ের ব্যপার।
(সমাপ্ত)
লেখকঃ সাঈদ মাহমুদ আলী রেজা, আয়ারল্যান্ড থেকে
সাঈদ মাহমুদ আলী রেজা: জ্ঞানগর্ভ লেখা পোস্ট দেবার মত জ্ঞানী মানুষ আমি নই। দেশ জাতি নিয়ে ভাবার যোগ্যতাও আমার নাই। তাবৎ দুনিয়ায় প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীতে ব্যক্তির নামকরনের নিজস্ব প্রচলিত প্রথা থাকলেও আমাদের নেই। সুদীর্ঘকাল বিদেশে থাকার কারনে সন্তানদের আর নিজের পাসপোর্ট নিয়ে ইমিগ্রেশন চেকিং এ দাঁড়িয়ে অনেকবারই বিব্রতকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে। আমার বিশ্বাস অনেকেরই হয়েছে। তাই বিবেকের তাড়না থেকেই লেখা। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসাটা জরুরি। আমার বিশ্বাস একটি ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরী করে, যুগ যুগান্তরের অনিয়ম ভেঙ্গে, আমাদের দেশেও একটি উপযুক্ত নেইমিং কনভেনশন প্রচলন করা সম্ভব। অবশ্যই সরকার, সামাজিক সংগঠনগুলো এগিয়ে আসতে হবে, আমাদের প্রয়োজনেই।
বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে নেইমিং কনভেনশন বা নামকরন প্রথা এবং আমাদের প্রেক্ষাপটঃ
(১ম পর্ব)
প্রায় প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীতে ব্যক্তির নামকরণের একটি নির্দিষ্ট রীতি রয়েছে। এটাকে বলে নেইমিং কনভেনশন। নেইমিং কনভেনশন বা নাম করন প্রক্রিয়া কোন একটি জাতির ঐতিহ্য বা সংস্কৃতির সাথে অঙ্গাঅঙ্গীভাবে জড়িত। এমনকি অনেক দেশে নামকরনের বিষয়ে সরকারী নিয়মনীতি এমনকি নানান ধরনের বিধিনিষেধও রয়েছে। জার্মানীতে সম্ভবতঃ সবচেয়ে কড়া বিধিনিষেধ, যেখানে ‘সিভিল রেজিষ্ট্রেশন অফিস’ কর্তৃক বাচ্চার নামের রেজিষ্ট্রেশন করাতে হয়। বিধি মোতাবেক না হলে বাবা মা তার সন্তানের জন্য পছন্দ করা নাম নাও পেতে পারে।
যদিও ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মাঝে নামকরণ প্রথা অনেক বিশদ আলোচনার দাবী রাখে, খুব সংক্ষেপে বিষয়টি তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
নাম ছোট বড় যাই হোক না কেন, নামের দুটো বা তিনটি অংশ থাকে;
১. প্রদেয় নাম বা ব্যক্তিগত নাম (Given name/ Personal name) এই অংশটিই ব্যক্তির পরিচিতিমুলক নাম। অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীতে নামের এই অংশ প্রথমে থাকে তাই একে নামের প্রথমাংশ (First name/Forename) ও বলা হয়। কারো এক বা একাধিক Given name থাকতে পারে।
২. পারিবারিক বা বংশগত নাম (Surname): প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীতেই এটি নামের আবশ্যকীয় অংশ।
৩. মধ্যাংশ (Middle name): অনেক জাতিগোষ্ঠী নামের মধ্যাংশ বা Middle Name ব্যবহার করে থাকে। এই অংশে সাধারণত প্রদেয় নামের (Given name) দ্বিতীয় বা বর্ধিত অংশ, বাবার নাম অথবা মায়ের বংশগত নাম ব্যবহার করা হয়।
নামকরণ প্রক্রিয়া দেশে দেশেঃ
১. এ্যাংলো অস্ট্রেলিয়ান জাতি সমুহঃ
ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া সহ সকল ইংরেজী ভাষাভাষী জাতি সমুহে প্রধানত ২টি বা ৩টি অংশ থাকে। প্রথম অংশ বা প্রথম দুটো অংশ প্রদেয় বা ব্যক্তিগত নাম, শেষাংশ পিতার বংশগত নাম। দ্বিতীয় অংশ ঐচ্ছিক।
যেমনঃ প্যাট্রিক ডেনিয়েল হিগিন্স Patrick Daniel Higgins (আইরিশ নাম)
প্যাট্রিক ডেনিয়েল প্রদেয় বা ব্যক্তিগত নাম ( First name) হিগিন্স বংশগত নাম (Surname)। দ্বিতীয় অংশ (Middle name) ডেনিয়েল কাগজে কলমে বা পরিচিতিতে ইদানীং খুব কমই ব্যবহৃত হয়। কাজেই ভদ্রলোক প্যাট্রিক হিগিন্স (Patrick Higgins) নামেই পরিচিতি পান। রীতি অনুযায়ী মহিলারা বিয়ের পর স্বামীর বংশগত নাম ধারন করেন। যেমন এমিলি স্মিথ (Emily Smith), প্যাট্রিক হিগিন্সকে বিয়ে করে হয়ে যান এমিলি হিগিন্স (Emily Higgins)
আইরিশ ছেলে মেয়েদের ব্যক্তিগত নাম (Given name) বাবা ও মায়ের পরিবার সদস্যদের নামে রাখা হয়, একটি বিশেষ প্রচলিত ক্রম ব্যবহার করে। যেমন পরিবারে প্রথম ছেলের নাম দাদার নামে, প্রথম মেয়ে নানীর নামে হয়ে থাকে।
২. আরবদেশ সমুহ ও মধ্যপ্রাচ্যঃ
আরবদের নামে সাধারনত নামের ৩ টি অংশ থাকে। প্রথমাংশে ব্যক্তিগত বা নিজস্ব (First name) নাম, দ্বিতীয়াংশে (Middle name) বাবার নাম, তৃতীয়াংশে (Surname) পিতার বংশগত নাম। যেমনঃ আহাম্মাদ সাইদ কালবানী (পুরুষ), নুরা আব্দুল্লাহ আলমামারী (মহিলা)। ভদ্রলোকের নিজ নাম আহাম্মাদ বাবার নাম সাইদ এবং পিতার বংশগত নাম কালবানী। মেয়েদের নাম বিবাহের পরও অপরিবর্তিত থাকে। কোন কোন আরব দেশে (সৌদী, সুদান) পিতার নামের পর পিতামহের নাম জুড়ে দেয়া হয়। যেমনঃ ইয়াসির সীদ-আহমেদ আবু-নুর আলখালিলি। নিজ নাম ইয়াসির, বাবা সীদ আহমেদ, দাদা আবু নুর, আল খালিলি বংশগত নাম।
৩. পুবের দেশ সমুহ ( চীন, জাপান, কোরিয়া, ইত্যাদি) অন্য জাতিগোষ্ঠীর মতো এদের (অধিকাংশ ক্ষেত্রে) নামের ২টি অংশ থাকে। কিন্তু মজার ব্যপার, ক্রমবিন্যাসটা অন্যান্যদের ঠিক বিপরীত। যেমন জ্যাং চেন (Zhang Chen) (চাইনিজ) ; কিম মিনসু (Kim Min-su) (কেরিয়ান), ইয়ামামোতো ইয়োকিয়ো (Yamamoto Yukio) (জাপানী)। এক্ষেত্রে জ্যাং, কিম কিংবা ইয়ামামোতো পিতার বংশগত নাম আর চেন, মিন-সু, ইয়োকিয়ো যার যার ব্যক্তিগত নাম। কাজেই এদের নামের ক্রমবিন্যাস [Family name] [Given Name]
৪. পর্তুগাল, স্পেন ও তাদের কলোনীভুক্ত দেশ সমুহঃ
এদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এক বা একাধিক নামের (First/ Given name) এর পর বাবা এবং মা দুজনের বংশগত নাম (প্রথমাংশ) ব্যবহার করে।
i) এক্ষেত্রে স্পেন বা স্পেনের কলোনীভুক্ত দক্ষিন আমেরিকার দেশ সমুহে (আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, পেরু, চিলি, কলোম্বিয়া, কোষ্টারিকা, উরুগুয়ে, প্যারাগুয়ে, পানামা, ইকুয়েডর, কিউবা ইত্যাদি)
এরা নিজস্ব নামের পর প্রথমে বাবার বংশগত নাম পরে মায়ের বংশগত নাম ব্যবহৃত হয়।
স্প্যানিশ নামঃ [Given Name(s)] [Father’s Surname] [Mother’s Surname]
* উদাহরনঃ জুয়ান রডরিগেজ জাপাটেরো (Juan Rodriguez Zapatero)
* ভদ্রলোকের ব্যক্তিগত নাম (First/ Given name) জুয়ান। বংশগত নামের (Surname) দুটো অংশ। রডরিগেজ বাবার বংশগত নাম, জাপাটেরো মায়ের বংশগত নাম।
* মনে করি এই ভদ্রলোকের বিয়ে হলো সোনসোলেস এস্পিনোসা ডিয়াজ (Sonsolese Espinosa Diaz) নামের মহিলার সাথে।
* তাদের ছেলের নাম রাখা হলো (Given name) এলবা (Alba)
কাজেই ছেলের পুরো নাম হবে Alba Rodriguez Espinosa অর্থাৎ Given name এর পর পিতামাতা ২ জনের Surname এর প্রথমাংশ।
ii) পর্তুগাল বা পর্তুগীজ কলোনীর দেশ সমুহে (ব্রাজিল, উরুগুয়ে, ভেনিজুয়েলা ইত্যাদি)
* পর্তুগীজ নামঃ [Given name(s)] [Mother’s Surname] [Father’s Surname]
এদের নিজস্ব নাম ( Given name) এক বা একাধিক থাকে। Sur name এর ক্ষেত্রে এরা বাবা মা এর বংশগত নামের একটি করে অংশ রাখে কিংবা এক একজনের দুটো দুটো করে পুরোটাই নামের সাথে জুড়ে দেয়, কিন্তু স্প্যানিশদের সাথে পার্থক্য হলো, এরা মায়ের বংশগত নামটি আগে রাখে, পিতারটি পরে।
* উদাহরনঃ লুইজ-জোয়াও অলিভিয়েরা সিলভা (Luiz Joao OLIVIERA SILVA) এক্ষেত্রে লুইজ জোয়াও নিজ নাম, ওলিভিয়েরা মায়ের বংশগত নাম এবং সিলভা পিতার বংশগত নাম।
* এদের কোন middle name থাকে না।
* মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর বংশগত নামেও ভাগ বসায়। তাই পর্তুগীজ মেয়েদের নাম অনেক লম্বা হয়ে থাকে। যেমন Maria do Carmo Mao de Ferro e Cunha de Almeida Santa Rita Santos Abreu
* সুদুর অতীতে অনেক অনেক নিজস্ব নাম (Given name) ব্যবহার করে বিশাল নাম রাখা পর্তুগীজদের আভিজাত্যের বহিঃপ্রকাশ ছিলো। পর্তুগালের রাজা ৪র্থ পেড্রোর নাম ছিলো
‘পেড্রো ডি এলসান্ট্রা ফ্রান্সিস্কো এন্টোনিও জোয়াও কার্লোস জেভিয়ার ডি পাওলো মিগুয়েল রাফায়েল জোয়াকুইম জোসে গনজাগা প্যাস্কেল ক্যাপ্রিয়ানো সেরাফিম ডি বরবোন ড্রাগাংকা।’
(পরবর্তী পর্বে, আমাদের প্রেক্ষাপট)
লেখকঃ সাঈদ মাহমুদ আলী রেজা, আয়ারল্যান্ড থেকে
জীবন জীবিকার তাগিদে সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসেছিলেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার নুর হোসেন (৫৩)। ২০০৭ সালে আমিরাতে একটি কোম্পানিতে কাজ শুরু করে। ২০১৫ সালে ওই কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নূর হোসেনের জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ।
অসুস্থতা সবকিছু কেড়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত অসুস্থ হয়ে তিনি হারালেন নিজের বাকশক্তি। এখন কথা বলেন ঈশারা-ঈঙ্গিতে। তার হয়ে কেউ পাশে না দাঁড়ালে নিজের মনের কথা অব্যক্তই থেকে যায় ক্যান্সার আক্রান্ত এ প্রবাসীর।
৬ বছর আমিরাতে লুকিয়ে কাজ করতে হয় এই হতভাগা প্রবাসী কোনো উপায় না পেয়ে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যর্থ হয়ে যায় প্রথম দফায় দেশে ফেরার চেষ্টায় টিকিট করে বিমানবন্দর পৌঁছালেও পাসপোর্টে মেয়াদ না থাকায় সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয় তাকে।
আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সিলর (শ্রম) লুৎফুন নাহার নাজিম গণমাধ্যমকে বলেন,সোমবারের ফ্লাইটে নুর হোসেন ছাড়াও দূতাবাসের সহায়তায় আল আইন হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকা গোলাম মাওলাও দেশে ফিরছেন। শুধু এ দু’জনই নন, এ ফ্লাইটে আরও অন্তত ৮ থেকে ১০ জন অসহায় প্রবাসী দূতাবাসের মাধ্যমে দেশে ফেরার সুযোগ পেয়েছেন।
স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আন্তর্জাতিক জাদুঘর ‘রেইনা সুফিয়া যাদুঘর’ পরিচলানা কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশি মানবাধিকার সংগঠন ভালিয়েন্তে বাংলাসহ অন্যান্য দেশের ৩৫টি সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রবাসে আনন্দের একদিন’ শীর্ষক এক জমকালো উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে দলমত নির্বিশেষে যোগ দেন বাংলাদেশ, আফ্রিকা, আলজেরিয়া, মরক্কো, কলম্বিয়াসহ ১৫টি দেশের বিপুল সংখ্যক প্রবাসী। প্রবাসী বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের একাধিক সংগঠন প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে আয়োজন করে বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান। কিন্তু এ বছর মাদ্রিদে প্রবাসীদের আনন্দ ছিল একটু ভিন্ন।গত শনিবার অনুষ্ঠিত উৎসবে ছিল নারীদের পিঠা উৎসব, সঙ্গীত ও নাচ, সেনেগালের পারসিউশনিস্টলা রুয়েদা, কলম্বিয়া সঙ্গীতডেসি মেসিয়াস গার্সিয়া, কলম্বিয়ান নাচ ‘কবিতা ভুলে যাওয়া’, প্রবাসী শিল্পীদের সঙ্গীত পরিবেশন, নৃত্য ইত্যাদি।
উৎসবে বিভিন্ন দেশের হরেক রকম খাবারের পাশাপাশি আফ্রিকান, এশিয়ান, আরাবি ও স্প্যানিশ সঙ্গীত পরিবেশন করা হয়। এ সময় বাংলাদেশি কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ভালিয়েন্তে বাংলার সাধারণ সম্পাদক রমিজ উদ্দিন সরকার, নারীনেত্রী আফরোজা রহমান, সাংবাদিক কবির আল মাহমুদ, তানিয়া সুলতানা ঝরনা এরিক, শাওন আহমদ, জাবেল, তেরেসা, দেলোয়ার হোসেন, আল আমিন পালোয়ান, জুলহাস উদ্দিন, মাহমুদা আক্তার, মামুন, গিয়াস উদ্দিন, ইসলাম উদ্দিন, ঈসা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ভালিয়েন্তে বাংলার সভাপতি মোহাম্মদ ফজলে এলাহী বলেন, প্রবাসে নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়িয়ে তোলা এবং বিদেশে দেশের আবহমান সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে অগ্রসরমান করা জরুরি। সেই সঙ্গে ভিনদেশিদের কাছে বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্য পৌঁছে দেয়া এবং পরিবার-পরিজন নিয়ে সবাই এক সঙ্গে হওয়ার আনন্দটা সব সময় অন্যরকম।বাংলাদেশি নারীনেত্রী আফরোজা রহমান বলেন, করোনার কারণে অনেক দিন পর এ রকম একটি সুন্দর বিকেলে কাটলো সবার। এজন্য তিনি রেইনা সোফিয়া জাদুঘর পরিচলনা কমিটিকে ধন্যবাদ জানান।
গত ২৭ বছরে একদিনও ছুটি নেননি ৭০ বছর বয়সী রেমিট্যান্স যোদ্ধা আবু বকর। প্রবাস জীবনের এই দীর্ঘ সময়ে একবারের জন্যও দেশে যেতে পারেননি তিনি। পরিবারের সুখের আশায় গত দুই যুগেরও বেশি সময় মালয়েশিয়ায় কর্মরত আবু বকর।
তার এ ত্যাগের ফলে এক মেয়ে বিচারক, এক ছেলে ডাক্তার অন্য একজন ইঞ্জিনিয়ার। প্রবীণ রেমিট্যান্স যোদ্ধা আবু বকর জানিয়েছেন, বর্তমানে তার মেয়েদের একজন বিচারক, এক সন্তান প্রকৌশলী এবং অন্য একজন ডাক্তার।
সন্তানদের এই সফলতাকে প্রবাস জীবনের বড় অর্জন হিসেবে দেখেন তিনি। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন স’ন্তানদের প্রতিও। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক হিউম্যান অব কুয়ালালামপুর নামের একটি পেজে এই বাংলাদেশির প্রবাস জীবনের সংগ্রামের কথা লেখা হয়।
দেশটিতে কর্মরত প্রবীণ এই প্রবাসী বলেছেন, ‘২৭ বছর তার পঞ্চম স’ন্তানকে মাত্র ৬ মাস ব’য়সে রেখে মালয়েশিয়া এসেছিলেন। তারপর আর দেশে যাওয়া হয়নি। আমার পরিবারকে মিস করি এবং তারাও আমাকে মিস করে। তবে আমার এই ত্যাগ তাদের জন্য এবং তাদের ভবি’ষ্যতের জন্য।
তিনি বলেন, আমি মালয়েশিয়ায় অসার আগে শুনেছি এখানে প্রচুর কাজ। এমন কোনো কাজও যদি থাতে যা কেউ করতে চায় না, তা আমি করবো। আমি একবারের জন্যও অ’সুস্থতার ছুটি নেইনি, ইনশাআল্লাহ আমি এখনও শ’ক্তিশালী।
এই রেমিট্যান্স যোদ্ধা বলেন, ‘আমার প্রয়োজন খুবই সামান্য। উপার্জনের বেশিরভাগ অংশই পরিবারের জন্য পাঠিয়ে দেই। সকালের নাস্তা করে কাজ করতে চলে যাই, আবার ফিরে আসি। পরিবারের সঙ্গে প্রতিদিনি ফোনে কথা হয়’। সুযোগ পেলে বিশ্রাম নেন। পরের দিন আবার একইভাবে দিন চলে যায় এই প্রবাসীর।