মধুমাসের অন্যতম ফল লিচু। রসালো টসটসে এই ফল ছাড়া বাঙালির গ্রীষ্মকাল পানসে হয়ে যায়। মিষ্টি স্বাদের লিচু পছন্দের তালিকায় থাকলেও ওজন বাড়ার ভয়ে খেতে চান অনেকেই। তবে পুষ্টিবিদরা অভয় দিচ্ছেন যে লিচু খেলে ওজন তো বাড়েই না বরং রোগা হতে চাইলে ডায়েটে রাখতে পারেন লিচু। এছাড়া লিচুতে রয়েছে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান।
পুষ্টিমান
লিচুতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ‘সি’ আছে। ক্যালসিয়াম দরকার হয় হাড়, দাঁত, চুল, ত্বক, নখ ভালো রাখতে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১০০ গ্রাম লিচুতে থাকে শর্করা ১৩ দশমিক ৬ গ্রাম, ক্যালরি ৬১ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, লৌহ দশমিক ৭ মিলিগ্রাম ও ভিটামিন ‘সি’ ৩১ মিলিগ্রাম।
মার্কিন ওষুধ প্রশাসন বিভাগ বলছে, প্রতি ১০০ গ্রাম লিচুতে ৬৬ কিলোক্যালরি শক্তি ও ১৬ গ্রাম শর্করা রয়েছে। চর্বি একেবারেই নেই। আরও আছে ৭১ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’, ১৭০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম, ১৪ মাইক্রো গ্রাম ফলেট এবং সামান্য পরিমাণ (১ মিলিগ্রাম) সোডিয়াম। ১০০ গ্রাম লিচু বলতে মাঝারি আকারের প্রায় ১০টি লিচুকে বোঝায়।
সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ
লেবু জাতীয় ফলের মতো লিচুতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে। গবেষণায় পাওয়া গেছে, ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ ফল শরীরের সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শরীরের প্রদাহজনিত ময়লা পরিষ্কার করে এবং মস্তিষ্ক বিকাশে সহায়তা করে। লিচুতে খুব ভালো পরিমাণে পটাসিয়াম ও কপারের মতো খনিজ রয়েছে। পটাসিয়াম আমাদের শরীরের কোষের জন্য খুবই উপকারী। এ ছাড়াও আমাদের হার্টের সুরক্ষা প্রদান করে এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
লিচু ক্যান্সার থেকে মানবদেহকে দেয় সুরক্ষা। এটি ক্যান্সার তৈরিকারী কোষ ধ্বংস করে। এতে অবস্থিত ফ্ল্যাভনয়িডস বা ভিটামিন ‘পি’ স্তন ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
লিচুর উপকারিতা
লিচু দেহের শক্তি বাড়ায়, এতে ভিটামিন ‘সি’-এর পরিমাণ কমলালেবুর তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি, গাজরের তুলনায় বেশি বিটা ক্যারোটিন আছে, বিটা ক্যারোটিনসহ প্রয়োজনীয় ভিটামিন শোষণে সহায়তা করে, লিচুতে থাকা কার্বোহাইড্রেট ও ফাইবার হজমে সহায়তা করে, বয়স্ক নারী যাদের মেনোপজ হয়ে গেছে, তাদের জন্য লিচু যথেষ্ট উপকারী, প্রচণ্ড ক্ষতিকর আলট্রাভায়োলেট রশ্মি থেকে শরীরকে রক্ষা করে, এতে থাকা নিয়াসিন ও রিবোফ্লাভিন নামক ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স শরীরের জ্বালাপোড়া, দুর্বলতা দূর করে, লিচুর ভিটামিন ‘এ’ রাতকানা কর্নিয়ার অসুখ, চোখ ওঠা, চোখের কোনা ফুলে লাল হয়ে যাওয়া দূর করে, ত্বকের স্বাভাবিক আর্দ্রতা ধরে রেখে ত্বকের যৌবন ধরে রাখে, চর্মরোগের ব্যথায় লিচুর বীজ ব্যবহৃত হয়, কচি লিচু শিশুদের বসন্ত রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বাকল ও শিকড়ের কস্ফাথ গরম পানিসহ কুলি করলে গলার স্বর ভালো হয়, বোলতা, বিছে কামড়ালে লিচুর পাতার রস ব্যবহারে ভালো হয়, ত্বকের তৈলাক্ততা দূর করায় লিচু খেলে ব্রণের উপদ্রবও কমে, কপালের ভাঁজ পড়া, ঠোঁটের চারপাশের বলিরেখা, গলা এবং বুকের পিগমেন্টেশন দূর করতেও লিচু ভূমিকা রাখে।
ওজন কমাতে
লিচুতে প্রচুর ফাইবার এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স আছে, যা মেটাবলিজম বা বিপাক ক্রিয়া বাড়াতে সাহায্য করে। মেটাবলিজম শক্তি কম হলেই মানুষের দেহে চর্বি বেড়ে যায়। লিচু এই মেটাবলিজম বৃদ্ধিতে দারুণ ভূমিকা পালন করে। ফলে শরীরে অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
লিচুতে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’র সঙ্গে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকার কারণে সর্দির সমস্যা, ফ্লু, কাশি প্রতিরোধে সহায়তা করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে লিচু কার্যকরী। লিচুতে ত্বকের কালো দাগ দূর করার ক্ষমতা আছে। এতে থাকা ভিটামিন সি, নিয়াসিন, থায়ামিন চুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে চুলকে কালো করে তোলে। লিচুর জলীয় অংশ শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ
লিচুতে প্রচুর দ্রবণীয় ফাইবার থাকার কারণে অন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা রোধ করে। পাশাপাশি পাকস্থলী ও কোলন পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। ফলে এটি কোষ্ঠকাঠিন্য রোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যের রোগে ভোগাদের জন্য লিচু খুবই উপকারী।
বুড়িয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা
মুখে বয়সের ছাপ আসার যে প্রধান কারণ তা আমাদের শরীরে উৎপন্ন হওয়া ফ্রি রেডিকেল। এই ফ্রি রেডিকেল রোধ করতে সবচেয়ে কর্মক্ষম হচ্ছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল খায় তাদের চেহারায় বয়সের ছাপ কম পড়ে। লিচুর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকায় এটি ত্বককে বুড়িয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করে।
মনে রাখতে হবে, সময়ের সঙ্গে মানুষের বৃদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দূষণ, কালো ধোঁয়া, ভেজাল খাদ্যসহ বিভিন্ন কারণে খুব দ্রুত মানুষের চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে যায়।
রূপচর্চা
৩টি লিচু ব্লেন্ড করে এর সঙ্গে ২ চা চামচ টক দই এবং ১ চা চামচ আটা মিশিয়ে ফেস মাস্ক তৈরি করা যায়। এই ফেস মাস্ক মুখে মেখে ১০ থেকে ১৫ মিনিট রেখে পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে। এই মাস্ক ময়েশ্চারাইজার হিসেবে কাজ করে। সপ্তাহে তিন থেকে চারবার এই মাস্ক ব্যবহার করলে ত্বক উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
শরবত
লিচু দিয়ে বানাতে পারেন সুস্বাদু শরবত। এ জন্য লাগবে আস্ত লিচু (বিচি ছাড়া) ৮টি, ১ টেবিল চামচ চিনি, ১ চা চামচ লবণ, ৩ চা চামচ গোলমরিচ গুঁড়া, ১ চা চামচ লেবুর রস এবং ১ কাপ পানি। প্রথমে আস্ত লিচু ছাড়া সব উপকরণ একসঙ্গে মিশিয়ে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করতে হবে। এরপর তা গ্লাসে ঢেলে ফ্রিজে রাখতে হবে। কিছুক্ষণ পর আস্ত লিচুগুলো গ্লাসের ভেতরে দিয়ে পরিবেশন করুন লিচু শরবত।
পায়েস
লিচু দিয়ে পায়েসও বানানো যায়। লিচু পায়েস বানাতে প্রয়োজন ২ লিটার দুধ, ২ কাপ চাল, ৩ কাপ মাওয়া, আধা কাপ চিনি, এলাচ ৩টা, দারুচিনি এক-দুই টুকরা, ৩ কাপ হেভি ক্রিম, আটটি লিচু কুচি। প্রথমে দুধ জ্বাল দিয়ে ২-৩ মিনিট পর চাল ধুয়ে দুধের মধ্যে দিতে হবে। একই সঙ্গে চিনি, এলাচ, দারুচিনিও দিয়ে দিতে হবে। চাল সিদ্ধ হলে এবং দুধ কমে ঘন হয়ে এলে মাওয়া, হেভি ক্রিম দিয়ে চুলার জ্বাল কমিয়ে দিতে হবে। এভাবে কয়েক মিনিট রেখে লিচু দিয়ে নামিয়ে ফেললে হয়ে যাবে দারুণ স্বাদের লিচু পায়েস।
গর্ভাবস্থায় লিচু খাওয়ার উপকারিতা
আপনার ডায়েটে লিচু অন্তর্ভুক্ত করে আপনি আপনার প্রয়োজনীয় পুষ্টির জন্য প্রতিদিনের প্রস্তাবিত মানগুলি পূরণ করতে পারেন।
1. ভিটামিন সি
লিচিসে উচ্চ মাত্রায় ভিটামিন সি (1) থাকে যা ইমিউন সিস্টেমকে উন্নত করতে সহায়তা করে।
2. পটাশিয়াম
পটাসিয়াম শরীরের সিস্টেমে তরল মাত্রাগুলি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক, অতএব, হার্টবিট এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে।
3. ফাইবার
লিচিস প্রচুর পরিমাণে ডায়েটার ফাইবার (3) সমৃদ্ধ, যা হজমে শক্তি হ্রাস করে, কোষ্ঠকাঠিন্য রোধ করে এবং অন্ত্রের গতিবিধি উন্নত করে।
4. অ্যান্টিঅক্সিড্যান্টস
ফলের মধ্যে ভাল পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট রয়েছে (4), যা ফ্রি র্যাডিক্যালগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে এবং অক্সিডেটিভ ক্ষতি রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
5. পলিফেনলস
লিচিসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফিনলিক যৌগ (5) থাকে, যা ওজন পরিচালনা এবং লিভারের ক্ষতির জন্য চিকিত্সা করতে সহায়তা করে। তারা টাইপ 2 ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধেও কাজ করে।