মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: শেখ সাদির পুরো নাম আবু মুহাম্মদ মোশাররফ উদ্দিন বিন মোসলেহ উদ্দিন আবদুল্লাহ সাদি সিরাজি। তিনি ইরানের সুপ্রসিদ্ধ ‘সিরাজ’ নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। সে দেশের রাজদরবারে সাদির বাবা চাকরি করতেন। সাদির বাবার নাম সৈয়দ আবদুল্লাহ। মায়ের নাম মাইমুরা খাতুন। কৈশরের আগেই কবির বাবা মারা যান। এ কারণে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল অনেক কষ্টে। তার মা তাকে নিয়ে কঠিন বিপদে পড়ে যান। শেষমেশ রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পিত হয় তার নানার ওপর। কিন্তু নানার অবস্থাও সচ্ছল ছিলন না।
ছোট্ট শেখ সাদি আর্থিক অনটনে স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এক ধনী ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাবী এবং পরিশ্রমী। ‘পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি’ কথাটিতে ছিল তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস। বাগদাদ নগরীতেই তিনি বেড়ে ওঠেন। ২১ বছর বয়সে শেখ সাদি একটি কবিতা লিখে বাগদাদের প্রধান বিদ্যালয়ের নিজামিয়া মাদ্রাসার একজন শিক্ষক আবুল ফাতাহ বিন জুজিকে দেন। সেই শিক্ষক তা পড়ে মুগ্ধ হয়ে শেখ সাদির মাসোয়ারার ব্যবস্থা করে দেন। ৩০ বছর বয়সে তিনি মাদ্রাসার শেষ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই সঙ্গে ধর্ম, দর্শন আর নীতিশাস্ত্রে অসামান্য পাণ্ডিত্য অর্জন করে ‘মাওলানা’ উপাধি লাভ করেন। এরপর তিনি মক্কায় হজ করতে যান। তার আর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য— তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। সে সময়ের পারস্য ছাড়াও তুরস্ক, সিরিয়া, জেরুজালেম, আর্মেনিয়া, আরব, মিসর, আবিসিনিয়া, তুর্কিস্তান এবং ভারতের পশ্চিমাংশ ভ্রমণ করেন। তার বয়স যখন আশি বছর তখন বাগদাদ নগরী হালাকু খান দ্বারা আক্রান্ত হলে হালাকু খানের নৃশংসতায় তিনি মর্মান্তিক কষ্ট পান। ভিতরে ভিতরে এতই কষ্ট পান যে তাকে পীড়িত করতে থাকে। বাগদাদের সঙ্গে ছিল তার হৃদয়ের সম্পর্ক। প্রায় ৪ বছরের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শেখ সাদি আজও বিশ্বের সাহিত্যাঙ্গনে স্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
শেখ সাদি নিজের সাদি ডাকনামটি গ্রহণ করেছিলেন সেলজুকি বংশের পঞ্চম সম্রাট বাদশা মুজাফফর উদ্দিন কুতলুগ খান আবুবকর বিন সাদ বিন জঙ্গির (১২৩১-১২৬০) নাম থেকে। এ বাদশার যুগেই ১২৫৮ সালে কবি ছয় দশক পরে তার জীবনের দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে শিরাজে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তখন ইরানি জনগণসহ সাদিকে বিপুল সংবর্ধনা দিয়ে বরণ করেছেন। ইরানে ফেরার পরেই সাদি তার বিখ্যাত গ্রন্থ গুলিস্তাঁ রচনা করেছেন। যতদূর জানা যায়, সাদির বেশিরভাগ রচনা শিরাজে প্রত্যাবর্তনের পরেই রচিত যুক্তিও সে-কথাই বলে। সুতরাং ‘সাদি’ ডাকনাম গ্রহণও সে কারণেই যথার্থতা পেয়েছে। সাদি কবি জীবনে নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির প্রশংসা করেছেন। তার মধ্যে রয়েছেন সাদির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধু শামসুদ্দিন মোহাম্মদ ও আলাউদ্দিন আতা মুলক জুয়াইনি। দুজনেই ছিলেন সে আমলের বিজ্ঞ মন্ত্রী। তবে তার কাছে সবচেয়ে প্রশংসনীয় ব্যক্তি ছিলেন এই বাদশাহ যার নামকে তিনি নিজের নামের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছেন। যদিও সে প্রশংসায় কোনো তোষামুদি কিংবা অতিরঞ্জন নেই। তার রচিত ‘গুলিস্তাঁ’ গ্রন্থটিও বাদশার নামে উৎসর্গ করেছেন। বাদশার মৃত্যু হলে গুলিস্তাঁ থেকে দুটি মর্সিয়াও তার উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়।
শেখ সাদি রচিত একাধিক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ‘গুলিস্তাঁ ও বুস্তাঁ’ নামক গ্রন্থ দুটি অন্যতম। গ্রন্থ দুটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। গদ্য ও পদ্য মিশ্রিত এই গ্রন্থ এখনো অমর হয়ে আছে বিশ্ব সাহিত্য ভাণ্ডারে। গ্রন্থ দুটি অনবদ্য পংক্তি সৃষ্টিতে যেমন সফল তেমনিভাবে সফল অভিভাকত্ব বজায় রাখার ব্যাপারে।
আমরা বাস্তব জীবনে শেখ সাদির সৃষ্টি অনুকরণ করলে বর্তমান সামাজিক অবক্ষয় থেকে মুক্তি পেতে পারি।