কামাল আহমেদ: আমাদের প্রিয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল বড়দের জন্যই লিখেননি, ছোটদের জন্য রয়েছে তাঁর অজস্র লেখা। আমরা রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর বাড়ির কঠিন নিয়ম কানুনের ভেতর দিয়েও শৈশব ও কৈশোরের দুরন্তপনার কথা স্কুল জীবনেই জেনেছি। বড় হওয়ার পড়ও তিনি শিশুদের মাঝে এলে নিজেও শিশু হয়ে যেতেন। তা তাঁর শিশুদের জন্য লেখাতেই প্রকাশ পায়। তাঁর শিশুতোষ লেখায় শিশুদের অাকাঙখা ও প্রজাপতির মতো রঙিন দিনগুলোর যে রূপ নিপূন ভাবে প্রকাশ পেয়েছে ; খুব কম লেখকের মাঝেই তা পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যে আকাশ ছোঁয়া পূর্ণতা এনে দিয়েছেন আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে এই পূর্ণতা এনে দিতেই তিনি অবিরাম লিখে গেছেন – ছড়া, কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ভ্রমণকাহিনী, রম্যসাহিত্য, পত্রসাহিত্য ইত্যাদি। তাঁকে ছাড়া বাংলা সাহিত্যে যেন কিছুই ভাবা যায় না।
কবির প্রথম জীবনের লেখা ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ তে শিশু সূলভ শব্দ চয়ন ও ছন্দের ঝংকারে অভিভূত না হয়ে উপায় নেই। বিভিন্ন শ্রেণিতে তার শিশু উপযোগী যে সব লেখা আমরা পেয়েছি, কেবল তা-ই ছোটদের রবীন্দ্রনাথকে জানার জন্য যথেষ্ট।
‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’- যেন বৃষ্টির জলে টইটুম্বুর।
বীরপুরুষ কবিতার কথা মনে পড়ে।
‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে,
আমি যাচ্ছি রাঙা ঘোড়ার পরে।’ বা
‘তুমি ভয়ে পালকিতে এক কোনে,
ঠাকুর দেবতা স্মরণ করছ মনে।
আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে,
আমি আছি, ভয় কেন মা করো।’
– এখানে একদিকে শিশু মনের স্বপ্ন, অন্যদিকে শিশু মনে জন্ম নেয়া এক ধরনের অভিভাবকত্ব প্রকাশ ; যা কেবল তাদের বেলায়ই এমন সরল-সুন্দরের দেখা মেলে।
রবীন্দ্রনাথের গানেও কেমন সুন্দর প্রকাশঃ
বৃষ্টির পর আকাশে রোদ উঠেছে। রংধনুর সাত রঙের লুকোচুরি খেলা। তখনই বেজে উঠেছে স্কুলের ছুটির ঘণ্টা। বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে বাড়ির পানে ছুটে চলা। এই আনন্দের মুহূর্তে আরো একটু বেশি আনন্দ দিয়ে গিয়ে কবি লিখেছেন-
‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে
বাদল গেছে টুটি,
আজ আমাদের ছুটি ওভাই,
আজ আমাদের ছুটি।’ – তে ছুটির আনন্দ, ছুটে চলার আনন্দ আর সেই মধুময় শৈশব।
যে ছড়াটি বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত সবচেয়ে সাড়া দেয়া, নাড়া দেয়া, সবচেয়ে মধুর- দোল জাগানো অানন্দ কৈশোরের, তা হলো-
‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে।’
এর প্রতিটি চরন শিশু মনে এতোটাই নাড়া দিতে সক্ষম যে, কালান্তরেও ওদের মুখে মুখে লেপ্টে আছে। এর কোন্ চরনের কথা বলি – প্রতিটি ছন্দের বাঁক যেন গ্রামীণ ছোট নদীর বাঁক, গাঁয়ের সরু আলপথ, পেছনে ফেলে আসা আনন্দ – রসধারা।
বৃষ্টি, নদী, চাঁদ, ফুল, পাখি – সবই শিশুদের প্রিয়। এসব নিয়ে ছোটদের রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠা রকমারি শিশু বাসনা ঠিক বুঝতে পারতেন।
‘মা যদি হও রাজি,
আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি’,
‘মেঘের মধ্যে যারা মাগো থাকে, তারা আমায় ডাকে।’,
‘আমি যাবো রাঙা ঘোড়ায় চড়ে’
– কী বিচিত্র বাসনা ! কখনো মাঝি, কখনো মেঘ, কখনো ঘোড়সওয়ার, আরো কত কী।
বাস্তব চিন্তা করলেও নিজেকে জড়িয়ে এমন অ্যাডভেনচার শিশুদের দারুণ প্রিয়।
কবি পাখি নিয়ে লিখেছেন-
‘কিচিমিচি করে সেথা
শালিকের ঝাঁক
রাতে উঠে থেকে থেকে
শেয়ালের হাঁক’।
কবি প্রকৃতিকে ভালোবাসতেন, বৃষ্টি ভালোবাসতেন। পাখির কিচির মিচির গান গাওয়া, নদীর কলকল ছলছল ছুটে চলার ধ্বনি কবি মনকে দোলা দিয়েছে। নদীর, বৃষ্টির, পাখির কথা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার ছড়া-কবিতায়। আষাঢ় মাসের মেঘ দেখে কবি বলেছেন-
“নীল নব গনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহিরে
ও গো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
কবি চাঁদকে নিয়ে লিখতেও ভুলে যাননি। চাঁদকে নিয়ে লিখেছেন একটি চমৎকার ছড়া-কবিতা-
“দিনের আলো নিভে এল
সূর্যি ডোবে ডোবে
আকাশ ঘিরে মেঘ ছুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।”
কবির বৃষ্টি নিয়ে গান-
“আজি ঝর ঝর মুখর
বাদলও দিনে।’
শিশুরা একসাথে হলেই নেচে নেচে গান গায়।
‘আয় তবে সহচরী,
হাতে হাতে ধরিধরি,
নাচিবি ঘিরিঘিরি
গাহিবি গান।’ – পড়তেই যেন চোখের পাতায় একরাশ স্বপ্নময় শৈশব ভেসে আসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শিশু – কিশোরদের জন্য লেখাগুলোর মধ্যে শিশু, শিশু ভোলানাথ, গল্প স্বল্প ছড়া, ছেলেবেলা, বিশ্ব পরিচয়, লিপিকা, মুকুট, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয়।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন গল্পের শিশু চরিত্র চিত্রায়ণে পারদর্শিতা দেখিয়েছেন দারুণ ভাবে। মিনি চরিত্র ছাড়াও পোস্ট মাষ্টার, ছুটি, বলাই, ইচ্ছে পূরণ ইত্যাদি গল্পের শিশু চরিত্রের কথা যারা গল্পগুলো একবারও পড়েছেন তারা ভুলতে পারবেন না।
রবীন্দ্রনাথের গানে, গল্পে, কবিতায় শিশুদের ইচ্ছা, হাসি, আনন্দ বিমূর্ত কিছু শব্দের আবেগকে মূর্ত করে রেখে গেছেন। তাঁর অসাধারণ এই শিশু-কিশোরদের রচনা ভাণ্ডার আজ ও আগামীর শিশুদের জন্যও থাকবে প্রেরণা- প্রেষণার উৎস হয়ে।