মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: কদু কথাটা শ্রবণে খানিকটা কটু হলেও কদু লাউয়ের ই আরেকটা নাম।বলতে পারেন ডাক নাম আর আসল নাম। লাউ শব্দ শ্রবণে যেমন একটা আভিজাত্যের ভাব আছে কদুতে তেমনটা নেই। কদু শব্দটা একটু গাউয়া গাউয়া লাগে।গাউয়া মানে হচ্ছে গেয়। তবে লাউ যতই ভি আই পি নাম হোক না কেন গ্রামেই তার উৎপাদন বেশী হয়।শহরের মানুষেরা লাউ পছন্দ করলেও লাউ এর ফলন ফলাতে পারেন না।বলবেন হঠাৎ লাউ-কদু নিয়ে পড়লাম কেন?ধীরে ধীরে বলি। বাক্য বেকায়দায় ব্যক্ত করলে আবার ভ্যাবাচ্যাকা খেতে হতে পারে। বলতে চাই আমরা ৫০ বছর আগে কদু ছিলাম এখন লাউ।
তাহলে আসুন এই লাউ অথবা কদুর তাৎপর্য তুলে ধরি। লাউ আমাদের দেশের একটি জনপ্রিয় তরকারি। পৃথিবীর আর কোন কোন রাজ্যে লাউ এতটা সমাদৃত তা আমার ভালো জানা নাই । লাউ একই সঙ্গে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর একটি সবজি। ঝোল, লাবড়া, নিরামিষ, ভাজি কিংবা সালাদ হিসেবেও খাওয়া যায় এই কদু। চিংড়ি, টেংরা, শিং, আইড়, বোয়াল, ইলিশ ও শোল মাছ দিয়ে রান্না লাউ অমৃতসম তরকারি ও লাউয়ের ব্রান্ড রেসিপি। এছাড়া বড় মাছের মাথা দিয়ে লাউয়ের তরকারি খুবই জনপ্রিয়। লাউয়ের বাকল কুচি করে কেটে আলু ভাজির মতো করে ভাজি করে খেতে সুস্বাদু। আর লাউ গাছের পাতা লতা দিয়ে শাক ভাজি সমগ্র বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয় ও পাতার স্যুপ, ভর্তাও অতুলনিয় স্বাদ। যে কোনো রোগীর পথ্য হিসেবে লাউয়ের ঝোল ঔষধের মতো কাজ করে।শুটকি মাছ দিয়েও লাউ খেতে দেখেছি অনেক জায়গায়।আমি লাউ বিচির ভর্তা ও বানাতে পারি।
লাউ এর নামকরণ এবং নামের বিশ্লেষণঃ লাউ হোক বা কদু। ইংরেজিতে: bottle gourd বা white-flowered gourd বলা হয় । কদুর বৈজ্ঞানিক নাম: Lagenaria siceraria। লাউ শীতকালীন সবজিগুলোর মধ্যে অন্যতম। লাউ এক প্রকার লতানো উদ্ভিদ যা এর ফলের জন্যে চাষ করা হয়। যা কিনা কাঁচা অবস্থায় সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।মোরগ বা মুরগির মাংস, খাসির মাংস ও গরুর সিনা দিয়ে লাউয়ের রান্না তরকারি অত্যন্ত উপাদেয়” প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পছন্দের সবজি ছিল এই লাউ। মোরগ হোক বা মুরগী হোক লাউএর সঙ্গে খেতে দারুণ।
লাউ স্বাস্থ্যের জন্য দারুন উপকারী একটি সবজি। আধুনিক বিজ্ঞানের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম গবেষনায় তার পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য আমাদের সামনে যদিও এখন বিদ্যমান কিন্তু প্রায় দেড় সহস্রাধিক বছর পূর্বে এমন গবেষনার অস্তিত্ব যখন কল্পনার অতীত ছিল তখনই এই সবজিটি আগ্রহভরে খেতেন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ সম্পর্কিত একটি হাদিস উদ্ধৃত আছে: – আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার একজন দরজি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাবারের দাওয়াত করেন। আমিও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে সেই দাওয়াতে অংশগ্রহণ করি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সামনে বার্লির রুটি এবং গোশতের টুকরা ও লাউ মিশ্রিত ঝোল পরিবেশন করা হয়। আমি দেখেছি, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্লেট থেকে খুঁজে খুঁজে লাউ নিয়ে খাচ্ছেন। আর আমিও সেদিন থেকে লাউয়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। -মুসলিম, হাদিস : ২০৪১।
লাউয়ের নাকি অনেক মধু-জানে গো জাদু। তবে লাউয়ের তরকারি যদি তেমনভাবে রান্না করা হয় সত্যিই যেন স্বাদের জাদু। বাঙালির খাদ্যতালিকায় লাউয়ের কদর কম নয়। কত কিছু দিয়েই তো লাউ রান্না করা যায়। কচি লাউ-চিংড়ি। আহা জিবে জল। খনার বচনেও আছে লাউয়ের বন্দনা, ‘উঠান ভরা লাউ-শসা, ঘরে তার লক্ষ্মীর দশা।’ মাংসে লাউ এই বিষয়টি প্রথম দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, তখন বাটিতে কব্জি ডুবিয়ে মাংস খুঁজতে গিয়ে লাউ পেতাম, লাউ দিয়ে ঘন দুধের মিষ্টান্ন, লাউয়ের চচ্চড়িসহ আরও কত কী! কচি লাউয়ের রং হালকা সবুজ, ভেতরে সাদা রঙের শাঁস। চট্টগ্রাম এর আঞ্চলিক ভাষায় হদু বলা হয়।
লাউ পৃথিবীর অন্যতম পুরনো চাষ হওয়া সবজি, এর জন্ম আফ্রিকায়। লাউ একটি ধ্বনি পরিবর্তিত শব্দ, যার মূল শব্দ ‘অলাবু’। লাউকে কোন কোন স্থানে আঞ্চলিক ভাষায় কদু বলা হয়। লাউ সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। শুধু লাউ নয়, লাউয়ের পাতা, লতা এমনকি লাউয়ের বাকলও খাওয়া যায়।লাউ দিয়ে ছোটবেলায় দুধকদু খেয়েছি। অসাধারণ সেই দুধকদুর কারিশমা ছিলো আমার দাদীর হাতের।আমার দাদী আনোয়ারা বেগম ১৯৮৭ সালে পটুয়াখালীর জেলার গলাচিপা থানার খারিজ্জমা গ্রামে পরলোকগমন করেন। আহা! দাদী পরলোকগত হওয়ার পর আর এমন খাদ্য ভাগ্যে জোটে নি। লাউ পরিপক্ব অবস্থায় শুকিয়ে বোতল, পাত্র বা নল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ কারণেই লাউ এর ইংরেজি নাম হয়েছে bottle gourd।
লাউ যে মনোহরা-বাজাও একতারা।’ বাদ্যযন্ত্রের কথা যখন উঠল তখন সেদিকেও যে লাউ কিছুটা এগিয়ে আছে তা বলাই যেতে পারে। সঙ্গীতেও লাউ অসামান্য অবদান রেখে চলছে! যদিও এই অবদানের জন্য কোনো লাউ এখনও পুরস্কার পায়নি।লাউ চাষী তো মোটেই নয়। শুকনো লাউয়ের খোল থেকে যে কত রকম তালবাদ্য ও বাজনা তৈরি হয় তার হিসাব নেই। ঢুগঢুগি, তবলা-বায়া-তানপুরা তো, লাউ-এরই প্রোডাক্ট বাই-প্রোডাক্ট। তা হলে একবার ভাবুন খাদ্য থেকে বাদ্য, লাউকে তুচ্ছ ভাবে কার-ই বা সাধ্য। বড় সাধের এই লাউ নিয়ে তাই মারামারি, কাড়াকাড়ি, বাড়াবাড়ি। তাই ‘যেই লাউ সেই কদু’ বলে হেয় জ্ঞান করার আগে ভাবুন। এই নিয়ে আবার লড়াই বাঁধবে না তো।আমি ছোটবেলায় মিষ্টি কুমড়োকেও এক প্রকার কদু মনে করতাম। লাউকে পুরুষ কদু আর মিষ্টি কুমড়ো কে স্ত্রী কদু।কারণ মিষ্টি কুমড়ো দেখতে সুন্দর। যেমন নারীরা সুন্দর। আমি মনে করি পুরুষদের চেয়ে নারীরা দেখতে সুন্দর।
কবি জসীমউদ্দীন বলেছেন , ‘জাঙলা ভরিয়া লাউয়ের লতায়, লক্ষ্মী সে যেন দুলিছে দোলায়।’ লাউ খুব একটা অভিজাত সবজি না হলেও আমাদের গানে-গল্পে এর বেশ কদর রয়েছে। সাধের লাউয়ের জন্য বৈরাগী হওয়ার কথা তো জানিই।ভূবন বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী শ্রদ্ধেয় রুনা লায়লার কন্ঠে সাধের লাউ গানটি শুনলে কে বলবে লাউ হেলাফেলার কোনো এক কদু?লাউ হোক আর হদু হোক, একে অবহেলা হইরবাইন না যে। এর ঠেলা বড়ো বেসামাল। প্রবাদ আছে কোনো কোনো কবি নাকি লাউ কিনতে গিয়ে আগাটা, ডগাটা বা ফুলটা ফাও চাইতেন। এগুলোও খেতে মজা। তার মানে শরীরে বা দর্শনে যতটাই বেঢক হোক না কেন বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে লাউয়ের জুড়ি নেই। আবার লাউ-ই নাকি পারে জামাই ঠকানো রান্না রাঁধতে! তার মানে দেখতে মনে হবে অনেক সবজি কিন্তু ভেতরে পানি! তাই লাউ নিয়ে যতই তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা হাসি-ঠাট্টা করা হোক না কেন চাঁন্দিফাটা গরমে লাউয়ের ডাল খেয়ে যেন প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কিন্তু গরমে চাঁন্দিফাটলে তো রক্ষা। আর যদি লাউয়ের জন্য মারামারি শুরু হয় তবে? হয়েছেও তাই।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার শান্তিপুর জামে মসজিদের জমিতে উৎপাদিত একটি লাউ না কি সম্প্রতি নিলামে তোলা হয়। এক কেজি ওজনের ওই লাউটির নিলামের ডাক দেন পাশের মদনপুর গ্রামের কবির মিয়া। লাউটির দাম ৬০০ টাকা পর্যন্ত ওঠে। এমন সময়ে বাধা দেন শান্তিপুর গ্রামের জালাল মিয়া। তার দাবি, এ নিলাম ডাকবেন তিনি। কবির মিয়া যেহেতু মসজিদের কেউ নন। তিনি নিলাম ডাকার অধিকার রাখেন না। এ নিয়ে বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে শুরু হয়ে যায় দুই গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ। সংঘর্ষে আহত হয় উভয় পক্ষের কমপক্ষে ৫০ জন। তাদের মধ্যে ২৪ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরপর থানা-পুলিশ ইত্যাদি ইত্যাদি। তাহলে বুঝুন এক লাউ পুরো এলাকা মাতিয়ে দিল। তাই তো বলি লাউয়ের শক্তিকে অবহেলা করবেন না লাউ কদু হইলে তেমন আর ক্ষতি কি! আমরা যে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও যেই লাউ সেই কদু রয়ে গেলাম তাই নিয়ে ভাবছি স্বাধীনতার আগে ছিলাম পাকিস্তানি আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পর লোকে বলে হিন্দুস্থানী। এর চেয়ে করোনাই শ্রেয়।