কামাল আহসান: দৈনন্দিনতার ভেতর থেকে বের হয়ে নিজের ঘ্রাণ ছড়িয়ে দেয়া নজরের সাথে নজর মেলানো যায়, এটা কোন সূর্যমুখির সাথে চোখাচোখি নয়। কর্ম- কোলাহলের ও তার হৃদস্পন্দন ভেদ করে আসা এরা সব আপনার কথারাই। আবার আপনার সাথে আকাশমুখি, নদীমুখি, ইয়ারমন বিলের মতো বিলমুখি, খালপাড়ের কলাগাছমুখি হয়ে চেয়ে থাকে প্রতিদিন একবার দেখার অপেক্ষায়। আপানকে ওরা আরও ঘনিষ্ঠ ভাবে চায়। আপনার চোখের থেকেই যখন বিল নদী খাল বের হবে তখনই ওরা বুঝবে আপনি ওদের নয় বরং ওদের চাহিদার মতোই আপনি আপনার হয়েছেন।
আপনার ভেতরের নজরটা সমুদ্রের কষ্টকে দেখতে পারে বু্ঝতে পারে। কবিদের মতো কখনো কবিতায় কখনো গানে বোঝাতেও পারেন। সবাই এমন করে পারবেন না, পারতেই হবে এমনও কোন বাধ্যবাধকতাও নেই। পৃথিবীর সব কবিরা তবে সমান মাপের কবি হয়ে যেতেন। তবে এটা সত্য যে, যে সমাজে বা রাষ্ট্রে যত বেশি মানুষ তৃতীয় নয়নমুখি, বোধের সাধক হয় সে রাষ্টের সৌন্দর্যরূপ ততই বৃদ্ধি পায়। যে বোধ আপনাকে দেখতে শিখিয়েছে, শুনতে শিখিয়েছে, দিয়েছে অনুভুতির যন্ত্রণা, তাতে আপনি একজন বিখ্যাত ডাইরিলেখক হয়ে উঠছেন কাগজে কলমে না লিখলেও। সবুজ সন্ধ্যার সাথে ধূসর চাহনি নিয়ে হলেও মেতে উঠতে চায় শুভ্রনীল আলাপচারিতায়। কেউ তাকে পাত্তাই দেয় না, কেউ কেউ জ্যামে আটকেপড়া অবসরে চোখ বুজে দেখতে থাকে শৈশব কৈশোরের দিন, সেইসব সন্ধ্যায় বাদুড়ের উড়ে যাওয়ার দৃশ্য।
কেউ একজন বোধের গভীরে ডুবে ভাবতে ভাবতে নিজেই সন্ধ্যার বাদুড় হয়ে ঢোকেন নিজের বাসায়। দামি সোফাসেট, দামি সব আসবাব তার নিকট সন্ধার আঁধারে ঢাকা তরতাজা কলাগাছ মনে হয়। নিজেকে আজ বাদুড় বানাতে ইচ্ছে করে। মাবুদ যদি তাকে বাদুড় বানিয়ে পৃথিবীতে পাঠাতেন তবে সে আরো খুশি এবং সুখি হতেন। মানুষের কথার শব্দ পেলে বাদুড়েরা নিজের নিরাপদ স্থান থেকেও ফস করে উড়ে যায় অন্য কোনো গাছে।
লোকটা অনেক রাত পর্যন্ত জাগলেন আজ। সে কখনো বাদুড় হতে পারবেনা সেটা তার জানা তবু আজ বিকেল থেকে এতো রাত পর্যন্ত শৈশবের বাদুড় হয়ে থাকল সে। বাদুড়ের মতো সূর্যের অস্ত যাওয়ার দৃশ্যটা দেখার অপেক্ষায় জানালা খুলে বসে রইলেন চুপচাপ। সূর্যাস্তের পরেই বাদুড়েরা কলাগাছ, পেয়ারাগাছ খুঁজতে চলে যায় দূরের বা পাশের কোনো গ্রামে। এসব বিষয় তার দেখা শৈশবের-কৈশোরের। সোফায় সবে সে চেষ্টা করতে লাগল বাদুড়ের মতোই গাছের ডালে অনেক বাদুড়ের সাথে ঝুলে থাকতে, একটু আঁধার নামতেই সে দেখতে লাগল, বাদুড়গুলো যে যার মতো উড়ে যেতে আরম্ভ করল। দেখল বাদুড়েরা ঝাক বেঁধে চলে না কিন্তু দিন কাটায় এক গাছে সকলেই। দু একটা বাদুড় সে ছোটবেলায় দিনেও একাকী গাছের ডালে ঝুলে থাকতে দেখেছে।
সেই একাকী থাকা বাদুড়গুলোকে আজ তার নিকট আলাদা ধরনের বাদুড় বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু কেমন আলাদা সেটা বুঝে উঠতে পারছেনা, পারেনি বা তখন সেই শৈশবে বাদুড়ের একা থাকা বা একাকিত্বটা ভাববার বিষয়টা মনেই আসেনি। তবে আজ সে সেই শৈশবের বাদুড়টা ঝুলে থাকতে দেখছেন। মনে হচ্ছে কোন পেয়ারা গাছের দিকে এখনই উড়াল দিবে পাকা পেয়ারার খোঁজে। এবার সে আর স্থির থাকতে পারল না। বাদুড়টার পাশের ডালে ঝুলে রইল। সন্ধ্যার আঁধার নামতেই বাদুড়টার সাথে সেও উড়াল দিলো উদ্দেশ্য বিহীন পথে। তার খুব ভালো লাগছে শূন্যে ভেসে থাকতে। আকাশে ওড়ার সব থেকে বড় প্রাপ্তির নামে গ্রামটা সম্পুর্ণ দেখা যায়। লোকটা বাদুড়টার সাথে বেশ কিছুক্ষণ উড়লো। আর নিজের গ্রামটা এই প্রথম উপড় থেকে দেখলেন সে, সত্যি তিনি একটা চিত্র দেখলেন, একটি গ্রামের চিত্র। সঙ্গী বাদুড়টা হঠাৎ নিচের দিকে নামছে দেখে সেও নামতে লাগলো, কিন্তু বাদুড়টা কি খাবার পাবে এখানে? সে কি জানে আগের থেকেই?
বাবা, তোমার অফিসে কোনো সমস্যা? নাকি শরীর খারাপ? কথা বলছ কারো সাথে, একা এসে বেলকনিতে বসে আছ। মন খারাপ লাগছে।
লোকটা মুখটা মেয়ের দিকে ঘুরিয়ে চমৎকার একটা হাসি দিয়ে বললো, মা’রে আমি মজাদার একটা ভ্রমনে ছিলাম।
বলতে বলতেও হাসছিলো। মেয়েটি আর ভ্রমন বৃত্তান্ত জানতে চাইলো না। বললো, ভেতরে চলো নাস্তা করতে, অফিসের থেকে এসে এখানেই বসে আছো, আমরা ভাবলাম অফিসের কোনো কারণে তোমার মন খারাপ। তাই আর ডাকিনি, বিরক্ত করিনি। শুনে আবার হাসলো লোকটা। বাবার মনটা ভালো দেখে এবার জানতে চাইলো,
তুমি হাসছো কেন বাবা?
জীবন নামের এই নৌকাটার চালক বা মাঝিতো আমি নিজেই, ঠিক না? যেমন তোমার নৌকার মাঝি তুমি।
বাবা, এবার তোমার ভ্রমনের কাহিনীটা বলো তো!
বেলকনিতে বসে বসে কেমন ভ্রমণ করলে, কোথায় ভ্রমন করলে?
এবার একটু ভাবুকমুখে বললো লোকাটা, অফিসের পেছনের আম গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম লাঞ্চের সময়। অনেক পুরাতন গাছ। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাদুড় এসে ঝুলে পড়লো ডালে। আমি একটা সুগন্ধ পেতে আরম্ভ করলাম, স্মৃতির সুগন্ধ। আমাদের বাড়িতে একসময় প্রচুর বাদুড়ের আড্ডা ছিলো। ওরা দিনের চেয়ে রাতে খাদ্য সংগ্রহ করতে পছন্দ করে।
বোধর সুদক্ষ শিল্পী এতে সন্দেহ করতে পারেন তবে, গভীর বোধ সাধারণ বোধের থেকে আলাদা। এটা মানতে আপত্তি আমার নেই। ক্ষুধা, প্রেম আর ভবিষ্যতের স্বপ্নের শরীরের আলো ও উৎসবের কথা; রোদের পোষাকে এসে ধরা দেয় খুব সংগোপনে, এক কলাগাছ থেকে অন্য কলাগাছে উড়ে যাওয়া ভয়ার্ত বাদুড়ের ফেলে যাওয়া কিছুটা ক্ষুধার গল্পটাকে জেগে ওঠানোর দায়ভার নিজ কাঁধে তুলে নিয়ে রাত জেগে সেই ক্ষুধার যে আলাপচারিতা চলে সেটাই আলাপ।
যখনই ধরা দেয় মানবিক সম্পর্কের রাত্রি- দিবসের নৌকা ও তার মসৃণ পাটাতন, তাকে ঘরে তুলে নেয়া, এটাও সেচ্ছায় দায়ভার আপনার। এটা রাখার যায়গা আপনারই আছে, যেদিন আপনি বোধের গভীরতায় ঢুকলেন সেইক্ষণে পেয়েছিলেন একটা একান্ত নদী, যার ঢেউ আছে, স্রোত আছে, কালবৈশাখে তার তুফানও আছে তুমুল ধক্কায়।
আপনার সেই পৃথিবী তার রঙিন আঁচলে জমা নদীদের থেকে এটা নদীও দিয়েছেন, সাথে নিজের আঁচল খানা। আপনার স্থানের অভাব, এটা আপনার ভাবতে মানা, আলোর অভাব, ভাবতে মানা, ক্ষুধায় কাতর কল্পনাও মননকে দোলাতে পারবেনা। আপনার ভেতরে প্রতিমুহূর্তে তৈরী হয়ে শত সহস্র কথা, তবে আর সময়ের অভাব আসবে কোথা থেকে। কয়েকটি অমূল্য ছায়া আশ্রয়ের নির্ভরতার গান গায় সেটাও আলাপ, বালক- বালিকাদের পুরুষ ও নারী হয়ে ওঠার আশ্চর্যতম আনন্দ। নারীর ভোরের স্নান ফেলা আসা ঘাটে পুকুরের জলে মেশানো প্রণয়মাখা সেই স্নানের সুগন্ধির আলাপ।
আমপাতা যাদের টুথপেস্ট, টুথব্রাশ যাদের আঙুল, মাঠে ছড়ানো নাড়া যাদের ডাকে নিজে শুষ্ক হলে, রুপালি ঢংয়ের এইসব দোকানের কাঠের বেঞ্চিতে সবে বসে যা বলা হয় তাই ক্ষুধা ও প্রণয়ের আলাপ। আপনাদের সাথে বোধের আলাপ করতে ভালো লাগলো। বোধের গভীরতাই কবিতার ক্ষেত্রভূমি। বোধের সাথে আমি কিছু মানুষের বেলায় গভীর শব্দটার ব্যবহার করলে প্রশান্তি পাই, কারণ তারা সেটাকে ধারণ করেন।
রচনাকালঃ ২৩শে ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রয়াত কবি কামাল আহসানের একটি অসাধারণ লেখা।