কামাল আহমেদ: ঐতিহ্য,বাংলা,বাঙালি ও বাংলা নববর্ষ – যেন এক অভিন্ন অস্তিত্ব। যে কোন জাতির ঐতিহ্য গুলো যুগে যুগে রূপ বদলায়, নতুন ঐতিহ্য যোগ হয়। কিছু ঐতিহ্য কখনো হারিয়ে যায় কিন্তু ঐতিহ্যের মর্যাদা হারায় না। গতকাল ভালো যা কিছু ছিল তা আজকের ঐতিহ্য, তেমনি আজ যা হবে আগামীকাল তা ঐতিহ্য তালিকায় যোগ হবে, এভাবেই চলবে। বাংলা নববর্ষ আমাদের এমনই এক ঐতিহ্য যা হাজার বছরেও রূপ বদলালেও দিনে দিনে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিচ্ছে।
বাংলা নববর্ষ প্রবর্তক ও কাল নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। বিতর্ক ধর্ম-জাতি ভিত্তিক বিভাজিত। তবে যে ঐতিহ্যে আমরা সবাই গর্ববোধ করি তা নিয়ে বিভাজন অযৌক্তিক বলে মনে করি। হিন্দু,বৌদ্ধ, মুসলমান মূলকথা নয়; কথা হলো-আমরা বাঙালি। বাংলা নববর্ষ-আমাদেরই।
উল্লেখযোগ্য দুটো বিতর্কই চলে আসছে। কেউ মনে করেন, তা প্রাচীন বঙ্গদেশের ( গৌড় ) রাজা শশাঙ্ক প্রচলন করেন। তাদের ধারণা সপ্তম শতাব্দিতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার মতে ১২ এপ্রিল এবং গ্রেগারিয়ান ক্যালেন্ডার মতে ১৪ এপ্রিল,৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দ এটি চালু হয়। দ্বিতীয় মতানুসারে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরী চন্দ্রবর্ষীয় পঞ্জিকা অনুসারে কৃষি ও খাজনা আদায় হতো। এতে ফসল তোলা ও খাজনা আদায়ে সময়ের একটা ধূম্রজাল সৃষ্টি হতে লাগলো। তাই সম্রাট আকবর প্রচলিত বর্ষপঞ্জির সংস্কারের নির্দেশ দিলেন জোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজীকে। তিনি প্রয়োজনের দিক বিবেচনায় প্রচলিত সৌরবর্ষপঞ্জির সংস্কারের মাধ্যমে নতুন এক বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। নতুন সন ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রবর্তন হলেও সম্রাটের নির্দেশে তা ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে কার্যকর করা হয়।
যাই হোক, সব বিতর্কের বাইরে চিন্তা করলে বাংলা নববর্ষ প্রাচীনকাল থেকেই বৌদ্ধ নয়, হিন্দু নয়,মুসলমান নয়; বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে রূপ নেয়। তখন রাজা,বাদশা, সম্রাট বা সামন্তরাজাগন রাজপূণ্যাহের আয়োজন করে প্রজাগণকে দাওয়াত করে পান,মিষ্টি আপ্যায়ন ও খাজনা করতেন। বৃটিশ শাসনকালে সরকারি কাজে খ্রিস্ট বর্ষপঞ্জির কদর বাড়লেও বাংলা নববর্ষ একবারে হারিয়ে যায়নি। পরবর্তীতে এর ব্যাপক সামাজিকীকরণ ঘটে। ব্যবসায়িকগণ সারা বছরের বাকী আদায়ের জন্য পূণ্যাহর আদলে শুভহালখাতা করে মিস্টিমুখ করান। পুরাতনকে ঝেড়ে মুছে নতুন উদ্যোমে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয় নিয়ে পথচলেন।
বাংলা নববর্ষের আনন্দে পরবর্তীতে নতুনমাত্রা যোগ হয়-গ্রামীণমেলা বা বৈশাখীমেলা। পাকিস্তান আমলে তাদের শাসন শোষণের বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে ওঠে বাংলা নববর্ষ। বিশেষ করে পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঐক্য গঠনে দারুণ ভূমিকা নেয়। ১৯৬৫ সালে প্রথম ছায়ানট- সাংস্কৃতিক সংগঠনের আয়োজনে রমনার বটমূলে বর্ষবরণ হয়। ক্রমে তা জাতীয় চেতনায় ঐক্য তৈরিতে সম্মিলিত শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। বকুলতলা, চারুকলা ইনিষ্টিটিউট, মঙ্গলশোভাযাত্রা নতুন মাত্রা দেয়। এসবের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে থাকে গ্রামেগঞ্জে। এসব মেলায় তরুণ তরুণী ও শিশুরা বর্ণিল সাজে, মুখোশ পড়ে আনন্দে মেতে ওঠে। এছাড়াও কোন কোন মেলায় কুস্তি, লাটিখেলা, মোরগের লড়াই, ষাঁড়ের লড়াই, বলিখেলা, ঘোড়দৌড়, পুতুলনাচ, নৌকাবাইচ, বায়োস্কোপ দেখা, ডেঞ্জারগেম, চড়কীদোলা , নাগরদোলা ইত্যাদিও থাকে। গ্রামীণ বৈশাখী মেলার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু স্থান হলো- রাজশাহীর শিবতলা,বগুড়ার গ্রামনগর, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট, আমবাড়ি, যশোহরের নিশীনাথতলা, কুষ্টিয়ার ঘোড়াপীরের মেলা, বরিশালের বাখাল, ব্যাসকাটি,বাটনাতল, হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের বৈশাখীমেলা, শতমুখার বান্নি, ব্রাম্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর, গোকর্ণঘাট, নবীনগর, খড়মপুর, কুমিল্লার কান্দুঘর, সিদলাই,নাঙ্গলকোট, চট্টগ্রামের বৌদ্ধদের মহমুনির মেলা, রংপুরের পায়রাবন্দ, মহাস্থানগড়, মহেশপুর, খুলনার সাতগাছি, সিলেটের জাফলং, টুঙ্গিপাড়া, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ,মুন্সীগঞ্জ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী স্নানঘাট,সোলারট্যাক, শুভাঢ্যা, শ্যামসিদ্ধিমেলা, কুকুটিয়ামেলা,ভাগ্যকুলমেলা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এসব মেলায় মানুষ সারাবছরের জন্য দুষ্প্রাপ্য জিনিষপত্র সংগ্রহ করে রাখে। সুবিধে এই- একসাথে সকল জিনিষের প্রাপ্যতা রয়েছে এখানে। ভিন্ন জীবনধারা ও বৈচিত্রময় সংস্কৃতির ধারক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ ঘিরে কিছু মেলা বা আনুষ্ঠানিকতা রয়েছে। এদের অন্যতম উৎসব হচ্ছে- বৈসাবি। এই বৈসাবি কে চাকমারা বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরারা বৈসুক বলে। মারমা জনগোষ্ঠী যুবক-যুবতিরা এইদিনে ওয়াটার ফ্যাস্টিভেল বা পানি ছিটানো উৎসব করে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।
এমনি ভাবেই বাঙালি ও বাংলাদেশীরা হাজার বছরের এই বাংলা নববর্ষের ঐতিহ্যকে চেতনায় লালন করে উৎসব আনন্দে মেতে ওঠে। বিশ্বাসকরি বাঙালিরা এ চেতনা-লুপ্ত হবেনা কখনো।