এস এম জাকির হোসেন: মাগরিবের নামাজ শেষে বড় মামা মসজিদ থেকে ফিরলেন। মিনু ফুপুরা চলে এসেছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘যাক, একটা চিন্তা দূর হলো, আমরা এখন বেরিয়ে পড়তে পারি।’
ছোট চাচা কিছু শুকনো খাবার কিনে আনলো। বিস্কুট, চিড়া, মুড়ি আর গুড়। লম্বা যাতায়াতে পথে ক্ষুধা মেটানোর জন্য এগুলোই হয়তো সম্বল হতে পারে। আমি আনুর জন্য প্রয়োজনীয় গুড়োদুধ কিনে নিলাম, যাতে বাড়িতে গেলেও রানুর সমস্যা না হয়। বড় মামা স্পষ্ট করে বলে দিলেন, ‘এখন থেকে কেউ আর বাইরে যাবে না।’
রাতে মামা সবাইকে নিয়ে বসলেন। আমাদের মধ্যে যে কোনো বিষয়ে সভা হলেই বড় মামা একটা দীর্ঘ বক্তৃতা দিবেন এটা অবধারিত। আর আমরা সবাই কোনো না কোনভাবে মিটিং এভয়েড করতে পারলেই যেনো বাঁচতাম। তবে সেদিন পরিস্থিতি এমন ছিলো যে প্রত্যেকেই মনযোগী শ্রোতা হয়ে গেলাম। খিলগাঁওয়ের মতো এখানেও পাকিস্তানি আর্মি ঘরে ঘরে হামলা চালাচ্ছে। লোকজন ধারণা করছে এলাকার ভেতর থেকেই পাক আর্মিকে কেউ কেউ খবর পাঠাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যেতে হবে। পারলে আজ রাতেই।
মনে হচ্ছিলো, মেজ চাচার ভেতরে এক ধরণের ইতস্থতা কাজ করছে। বড় মামা বিষয়টা লক্ষ করে বললেন, ‘ফজলু, কোনো সমস্যা?’
মেজ চাচা আমতা আমতা করে বললেন, ‘আরেকটু ভাবলে হতো না? পরিস্থিতি স্বাভাবিকও তো হতে পারে।’
বড় মামা বললেন, ‘মানে! হঠাৎ তোমার মতের বদল হলো যে! বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে এই বিপদের মধ্যে থেকে যাবে?’
আমি বুঝলাম না মেজ চাচা এখন এমন করছেন কেনো। তাঁর বাসায় যখন ছিলাম তখন তো তিনিই তাড়া দিচ্ছিলেন।
চাচা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘দাদা, ব্যাপারটা তা না। আসলে মন মানে না। ভাবছিলাম, এত বছরে যা কিছু অর্জন, সবই তো ফেলে রেখে যেতে হচ্ছে। ফিরে এসে আবার সব ঠিকঠাক পাবো তো!’
বড় মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘পঁচিশ তারিখ ঢাকায় কী হইছে তুমি জানো? এখন ঢাকার কোথাও আমরা নিরাপদ নই। আর কিছু করার নাই। আমাদের সবকিছুই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে যেতে হবে।’
আসাদ ভাইকে গত কয়েকদিন ধরেই মেজ চাচা আর বড় মামাদের এলাকার চায়ের দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। আমরা অনেকেই ভেবেছি চা বিড়ির নেশা মেটাতেই লোকটা বাইরে যায়। আসল ব্যাপারটা ছিলো আসাদ ভাই চা খেতে যাওয়ার ছলে এলাকার লোকজনের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতো। বড় মামার কথার উত্তরে সে বললো, ‘শুধু পঁচিশে মার্চই নয়, ছাব্বিশে মার্চে কী কম হত্যা হয়েছে? পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কোর্ট হাউস স্ট্রিট ও গোয়ালনগর এলাকায় অনবরত গুলিবর্ষণ চলেছে। আগুনে ছারখার করেছে সব। সাতাশ তারিখ নওয়াবপুর থেকে ইংলিশ রোডের রাস্তার দু’ধারের দোকানগুলোতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। কেউ ঘর থেকে বেরুলেই গুলি করে মেরেছে।’
নুরুল ফুপা বললেন, ‘আমিও শুনেছি মালিবাগে একটি মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। সেখানে না কি মানুষও মেরেছে পাক সেনারা।’
বড় মামা চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘বলো কী! এই অবস্থা করেছে মিলিটারী বাহিনী? এত খবর তো জানতেও পারি নাই।’
আসাদ ভাই আবার বললো, ‘শুধু পঁচিশ ছাব্বিশ তারিখেই নয়, তার পরেও সারা ঢাকা শহর লাশের মিছিলে সয়লাব ছিলো। পিলখানা, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, তেজগাঁও, ড্রাম ফ্যাক্টরি, কচুক্ষেত, ইন্দিরা রোড, গণকটুলি, কলাবাগান, ধানমন্ডি, কাঁঠালবাগান, শেরেবাংলা নগর এলাকায় ঢাকা বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। মিরপুরে রাস্তার পার্শ্বে শত শত বাঙালি যুবকের ছড়ানো ছিটানো লাশ দেখা গেছে। আর বুড়িগঙ্গাকে তো ওরা লাশের ভাগাড়ে পরিণত করেছে।’
বড় মামা আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি এত খবর পাও কই?’
‘মামা, আমরা পুলিশের লোক। খবর সংগ্রহ করাই আমাদের প্রথম কাজ। এ ক’দিনে খিলগাঁও আর গোরানে ঘুরে ঘুরে সব খবরই নিতে হয়েছে। মৃত্যুর খবর, এইসব এলাকার স্বাধীনতা বিরোধীদের তথ্য।’ আসাদ ভাই মৃদু হেসে বললো।
আমি মেজ চাচাকে বললাম, ‘চাচা, বড় মামা ঠিকই বলেছেন। আমাদের কালকের মধ্যেই ঢাকা ছাড়তে হবে। তা না হলে খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারে। যা হয়তো কোনদিনই আর পূরণ হবে না।’
অবশেষে মেজ চাচা মেনে নিলেন। ‘ঠিক আছে, যা থাকে কপালে, চলেন কালকেই বেরিয়ে পড়ি।’
সিদ্ধান্ত হলো কাল ভোরেই রওনা হবো আমরা। ছোট বড় মিলে ছত্রিশ জনের দল। সব নিজেরা নিজেরাই। তিন ছেলেমেয়ে আর কাজের লোকসহ বড় মামারা ছয়জন, কাজের লোকসহ ফুপুর পরিবারে পাঁচজন, বড় আপা, মেজ চাচা ও ছোট চাচা তিন পরিবারে চার জন করে বারো জন, মা বাবা, দাদা দাদি আর আসাদ ভাইসহ আমরা আটজন আর ছোট মামারা তিনজন। সেইসাথে যোগ হয়েছে চন্দন ঊষা। এত বড় দল নিয়ে যাত্রা করতে হবে, যাদের মধ্যে শিশু এবং মহিলার সংখ্যাই বেশি। সাথে আছে আমার পঙ্গু দাদা, যাকে পুরো পথ জুড়ে আমাদেরকেই বয়ে নিয়ে যেতে হবে। আশির কাছাকাছি বছরের বয়স্কা দাদি, যার পক্ষে এতটা পথ হাঁটা বেশ কষ্টকর হয়ে পড়বে। যাত্রাকালে সম্ভাব্য সমস্যাগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো। আমরা যতটা সম্ভব হাইওয়ে এড়িয়ে চলবো। নৌকা, রিকশা কিংবা ভ্যানেই যেতে হবে বেশিরভাগ পথ।
সারারাত আমরা বলতে গেলে জেগেই কাটালাম। বড় মামা বুঝিয়ে বলছিলেন। পুরো যাত্রাপথের একটা প্ল্যান নিয়ে মাঝে মধ্যে আলোচনা চললো। বাইরের ঘরগুলোর আলো নিভিয়ে আমরা ভেতরের ঘরে বসে নিচু স্বরে সবাই কথা বলছিলাম যাতে বাইরে থেকে কেউ শুনতে না পায়। হয়তো এতটা সাবধানতার দরকার ছিলো না, তবে আমরা কোনো রিস্ক নিতে চাইনি। কোন রুটে কীভাবে আমরা এগোবো। পথে কি কি ধরনের সমাস্যার মুখোমুখি হতে পারি, আর কীভাবে তা মোকাবেলা করবো। যানবাহন ব্যবস্থা, পাকবাহিনীর গতিবিধির খোঁজ-খবর জেনে কীভাবে অগ্রসর হবো। বাকিটা পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠিক হলো আমরা গোরানের পেছন দিয়ে পায়ে হেঁটে যাত্রা শুরু করবো। তারপর চিটাগাং রোড পার হয়ে নারায়ণগঞ্জে ঢুকে পড়বো।
ফুপা বলে উঠলো, ‘মিয়াভাই, নারায়ণগঞ্জ কী নিরাপদ? ওখানেও আর্মিদের টহল থাকতে পারে।’
আসাদ ভাই বললো, ‘নারায়ণগঞ্জ নিরাপদ না, তবে কেরানীগঞ্জের রাস্তাটাও অতো সোজা না। চায়ের দোকানে শুনলাম, কয়েকদিন আগে জিঞ্জিরায় মিলিটারীরা হামলা করছে। নৌকা বোঝাই নিরীহ মানুষজনদের উপর কামান চালানো হইছে, পাক সেনারা জিঞ্জিরায় ঘরবাড়িতে আগুন দিয়েছে। আর এতে মদদ দিয়েছে পুরান ঢাকার বিহারিরা। আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নাই।’
আসাদ ভাইকে সমর্থন করে সফিক ভাই বললেন, ‘আসাদ ঠিকই বলেছে। নারায়ণগঞ্জে পাক আর্মি থাকতে পারে। তবে আমাদের চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। চারিদিকের অবস্থা আর আর্মিদের গতিবিধি বুঝে হয়তো আমাদের রিমোর্ট এরিয়াটাই বেছে নিতে হবে। কিছুটা কষ্ট হবে, সময় বেশি লাগবে কিন্তু কিছু করার নেই।’
আসাদ ভাই আবার বললেন, ‘বেশি রিমোর্ট এরিয়াতেও যাওয়া যাবে না। আমাদের সাথে দাদির মতো বয়স্কা মানুষ আর বাচ্চারা আছে। সবদিকে চিন্তা করেই পথ চলতে হবে। তবে এখনই এতকিছু ভেবে লাভ নেই। অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।’
আমরা সবাই অনুধাবন করলাম এছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। মামা আবার শুরু করলেন, ‘তাহলে এটাই ফাইনাল হলো যে, আমরা নারায়ণগঞ্জ হয়ে মুন্সীগঞ্জে ঢুকে পড়বো। তারপর গ্রামের ভেতর দিয়ে দিঘিরপাড়ে পৌঁছবো। ভাগ্য ভালো থাকলে নৌকা পাওয়া যেতে পারে। ওখানে গেলে একটা উপায় বেরিয়ে যাবে।’
মামার কথা শেষ হতেই আমি বললাম, ‘একটা জরুরি কথা; যার যার কাছে ছাতা আর টর্চ আছে তারা যেনো সাথে নিয়ে নেয়। সাথে মোমবাতি আর দিয়াশলাই। আমার কাছে একটা চার ব্যাটারির টর্চ আছে, নতুন ব্যাটারি ভরা। আর কার কার কাছে আছে?’
বড় মামা, ছোট মামা আর মেজ চাচা প্রত্যেকেই জানালো তাদের কাছে আছে। আসাদ ভাই বললো প্রত্যেকেই যেনো তাদের টর্চগুলোতে নতুন ব্যাটারি ভরে নেয়। বড় মামা বললেন, ‘এক প্যাকেট মোমবাতি আর কয়েকটা ম্যাচবক্স আমি কিনে রেখেছি, তবে টর্চে ব্যাটারি ভরা নেই। আজ তো আর সম্ভব নয়, কাল পথে কোথাও থেকে ব্যাটারি নিয়ে নিতে হবে।’
মামার কথা শেষ হলে সবাই যার যার ব্যাগগুলো আবার চেক করে নিলো, প্রয়োজনীয় কোনকিছু বাদ পড়লো কি না। রাত বাড়ছে। ঘরভর্তি মানুষ কিন্তু আমাদের কারো চোখে ঘুম নেই। মহিলাদের উদ্দেশ্যে বড় মামা বললেন, ‘তোমাদের সব গহনা সাথে নিয়ে এতদূর যাওয়াটা উচিৎ হবে না। প্রয়োজনীয় কিছু সাথে রাখো, বাকিটা এখানে কোনো নিরাপদ জায়গায় লুকিয়ে রেখে যাও।’
রানুর ভারী গয়নাগুলো বড় মামি এবং অন্যান্যদের সাথে তাদের রান্নাঘরের ফ্লোরে পুতে রাখা হলো। কেবলমাত্র সবসময় ব্যবহার্য কিছু হালকা গহনা, কয়েকটি আংটি সাথে থাকলো। মেজ চাচা বললেন, ‘আরও কিছু গহনা সাথে রাখো, বিপদে কাজে লাগবে। জরুরি মুহূর্তে ওগুলো বিক্রি করে প্রয়োজন মেটাতে পারবে।’
মেজ চাচার কথামতো রানু একটি হার, কয়েকটি গলার চেইন, কানের দুল, ছোট ঝুমকা আরও কিছু আংটি তার নিজের ব্যাগে নিয়ে নিলো।
সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলার পর সাদামাটা ছাপা শাড়ি পড়া উষাকে একদমই চেনা যাচ্ছিলো না। প্রায় আধো ঘোমটা দেয়া অন্য যে কোনো মুসলিম রমণীর মতোই মনে হচ্ছিলো। বড় মামি যখন কুলসুম বলে ডাকলেন, কুলসুমরূপী উষাও জবাব দিলো স্বাভাবিকভাবে। মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘এ কোন যুগ আইলো? বাঁচনের লইগ্যা মাইনসেরে কত কী যে করতে অয়!’
মা আমাকে বার বার বলছিলেন, ‘অ সুরুজ, তুই একটু ঘুমাইয়া ল, কাইল থেইক্যা অনেক ধকল যাইবে। এরপর কহন যে ঘুমাইতে পারোস তার ঠিক আছে?’
কিন্তু ঘরের কারোই ঘুমানোর মতো অবস্থা ছিলো না। আমরা শুধু শেষ রাত্রের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার দু’চোখ কেবল ঘুমে জড়িয়ে আসছিলো। হঠাৎ মায়ের ডাকে জেগে উঠলাম। তখনও ফজরের আযান হয়নি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম বাইরে অন্ধকার এবং সারা এলাকা নিঝুম নিস্তব্দ। মোমবাতির মৃদু আলোয় তৈরি হচ্ছে সবাই। আনুর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছিলো রানু। মা বাদবাকি সবকিছু দেখাশুনা করছিলো। আমার পঙ্গু অন্ধ দাদাকে বাবা আর দাদি মিলে দীর্ঘ পথযাত্রার জন্য যখন তৈরি করাচ্ছিলেন। দাদা তখন বাবাকে বলছিলেন, ‘ও আব্দুল্লাহ, রাইত পোহাইছে নি? এত রাইতে ঘুম থেইক্যা তোলছো ক্যা?’
দাদা অন্ধ হলেও কিভাবে যেনো বুঝেছিলেন তখন রাত শেষ হয়নি।
বাবা বললেন, ‘নামাজ পড়বেন না?’
‘পড়মু তো। আযান দেছে?’
‘হ।’
‘ও।’
আমি উঠে হাত মুখ ধুয়ে দেখি সব গোছগাছ শেষ। তখনই পাশের মসজিদ থেকে ভেসে আসছিলো ফজরের আযান। আমরা সবাই ঘরেই নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর যার যার ব্যাগ হাতে নিয়ে দুর্গম যাত্রার উদ্দেশ্যে পথে নামলাম। সাথে নেয়া হলো ছোট চাচার আনা সেই শুকনো খাবার চিড়া মুড়ি গুড় আর বিস্কুট।