মিন্টু রহমান: সব কিছু’রই শেষ কথা বলে কিছু নেই বলা হয়ে থাকে, তবে নজরুল সংগীত এর বেলায় কোন ভাবেই এই কথা প্রযোজ্য নয় নির্দ্বিধায় বলতে পারি–বাঙালী গীতিকবি তো অবশ্যই– ভিনদেশী, অন্যভাষী গীতিকবি দের বেলায় তা প্রযোজ্য হতে পারে ,কিন্তু নজরুল এর ব্যপারে এখনো কেউ এ কথা প্রমাণ করতে পারেনি– এখানেই নজরুল সবার চাইতে শ্রেষ্ঠতম গীতিকবি, সুরকার ,সংগীতস্রষ্টা, সংগীত পরিচালক ও সংগীতজ্ঞ হিসাবে বিবেচিত। তিনি কেন শ্রেষ্ঠতম বলে দাবীদার তা অবশ্যই ব্যখ্যা করা’র মত যথেষ্ট উপাদা ন তার গানে রয়েছে বলে এর পক্ষে সহজ ও অকাট্য প্রমাণ কিম্বা উদাহরণ দেয়া খুবই সহজঃ—
(১) নজরুল সংগীত এর বাণী,সুর, শব্দচয়ণ,ছন্দ, উপমা উতপ্রেক্ষা,চিএকল্প, বিদেশী শব্দ ও সুর আমদানি, বাণী’র সাথে সুরে’র সফল প্রয়োগ,উর্দু/হিন্দী বন্দিশ অবলম্বনে বাংলা খেয়াল এর সার্থক সৃষ্টি , পারস্যে’র কবি হাফিজ-রুমী’র কবিতা-গানের সফল অনুবাদ করা, বাংলা’য় গজল সৃষ্টি , আধুনিক গানের সৃষ্টি ইত্যাদি আরো কত কি যে বলে শেষ করা যায় না–এ জন্যই বলছি যে সব কথার শেষ না থাকলেও নজরুল সংগীত এর নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ বাণী ও সুর সৃষ্টি’র পর আর শেষ কিছু অাছে বলে মনে হওয়ার কোন কারণ থাকতে পারেনা– এ ক্ষেত্রে আমি ১০০% নিশ্চিত।

(২) নজরুল নিজে গান লিখে সুর করে শিল্পীদের তুলে দিয়েছেন গ্রামোফোন রেকর্ড করার লক্ষে, তাই একজন শিল্পী তার নিজস্ব মেধা, দক্ষতা ও কন্ঠ চর্চা’র বদৌলতে যথাসম্ভব নজরুল এর কাছ থেকে গানটি’র গায়কী/স্টাইল অায়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছে সত্য, কিন্তু নজরুল এর হুবুহু(true copy)গায়কী/স্টাইল কে অায়ত্বে আনতে কখনোই পারেনি যা সকলেই স্বীকার করবে–এরি প্রেক্ষিতে যেমন আংগুরবালা,ইন্দুবালা,কমলা ঝুরিয়া,হরিমতি, আব্বাস উদ্দিন, কে মল্লিক, যুথিকা রায়,ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিএ,শচীন দেব,জ্ঞাণ গোস্বামী,চিও রায়,গীরিণ চক্রবর্তী, কমল দাশ গুপ্ত ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত শিল্পী সহ স্মরনীয়-বরণীয় গুনীজনদের কথা বলতে হয়, নজরুল যে সবার গান শুনে খুশী হয়েছে এ কথা বলা যাবে না–আবার অনেকের গান শুনে মুগ্ধ ও হয়েছেন বললে ভুল হবেনা–তবে তার সম্পূর্ণ চাওয়া যে পূর্ণ হয়েছে এটা কিছুতেই বলাও ঠিক হবেনা , তবুও নজরুল এর অর্ডারি গান, নাটকের গান,সিনেমা’র গান, বিভিন্ন গ্রামোফোন কোং তে চাকুরীকালিন ও ট্রেইনার হিসাবে নিযুক্ত থাকার সময়ে’র গান তাকে পেটে’র ক্ষুধা’র করাণে রচনা ও সুর করতে হয়েছে-তবে নিজের মনের মত বা যে ভাবে তা গাওয়া দরকার ছিল তা কিন্ত পাননি–এখানেই তার creation/creativity প্রতিটি ক্ষেত্রে হোচট খেয়েছে বলা যেতে পারে, তাই নজরুল সংগীত এর সম্পূর্ণ গায়কী/স্টাইল যে আমরা ধরতে পেরেছি বা আয়ওে আনতে সক্ষম হয়েছি, এ কথা বলা ও ঠিক হবে না—নজরুল এর কন্ঠে গীত রেকর্ডে গানগুলো শুনলে তার গায়কী ও তার গানে কতটা পর্যন্ত স্বাধীনতা ভোগ করা যাবে তার কিঞ্চিত হিসাব হয়তো মিলবে, বিশেষ করে “পাষানের ভাংগালে ঘুম” এবং “দাড়ালে দুয়ারে মোর” গান দু’টি উল্লেখযোগ্য।
(৩) নজরুল সংগীতের স্বর্ণযুগে’র শিল্পীদের অনুকরণে সম্ভবতঃ দেবকন্ঠ মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় তার ধারালো কন্ঠে ও বাংলা গানে’র ভান্ডার বলে পরিচিত সুপন্ডিত বিমান মুখোপাধ্যায়(HMV) এর ট্রেনিং-প্রাপ্ত হয়ে নজরুল সংগীত কে মহা মর্যাদা’র অাসনে অবশ্যই পুণঃ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন –যা আর কোন শিল্পী করতে এতটুকু চেষ্টা করেনি কিম্বা কারো কন্ঠে অাজ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

(৪) আমাদের দেশের জনপ্রিয় নজরুল সংগীত শিল্পী সোহরাব হোসেন,খালিদ হোসেন,ফেরদৌসি রহমান, জুলহাসউদ্দিন, ফাতেমা তুজ জোহরা,ফেরদৌস আরা, ইয়াকুব আলী খান,ফেরদৌস আরা,রওশন আরা মোস্তাফিজ, সিফাত ই মন্জুর, খায়রুল অালম শাকিল,জোসেফ কমল রড্রিক্স,শবনম মুস্তারী, শহীদ কবির পলাশ সহ অনেক শিল্পী নজরুল সংগীতে’র আদি গ্রামোফোন রেকর্ড হুবুহু অনুসরণ করে ওই সব শিল্পীদের স্টাইলে গান করতে পেরেছে বা করেছে? যদি না-ই পেরে থাকে/ইচ্ছকৃত করেনি তবে এরাও ওতো গ্রামোফোন রেকর্ড অনুসরণ না করার অভিযোগে সমান দোষী বললে ভুল হবেনা–এ ছাড়াও আজকের শিল্পীরা কি নিজেদের ইচ্ছামত কাজকর্ম ও অলংকরণ করে গান গাইছে না?এরা তো “সুধীন দাস মার্কা” স্বরলিপি ভিওিক গান গেয়ে নজরুল কে আরো বেশী styl বিকৃত /অপমান করতে পারে না-তেমনি মানবেন্দ্র ও পারেনি, ধরুন মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায় যদি শ্রী সুধীন দাস এর শেখানো গান গাইতেন– বলুন তো নজরুল সংগীত কি আর নজরুলীয় স্টাইলে পরিবেশিত হতো, রবীন্দ্রসংগীত হয়ে যেতো না কি?
(৫) আমার মাথায় যতটুকু এসেছে এরি ধারাবাহিকতায় আপনারা এর পক্ষে বা বিপক্ষে আরো একটু এগুতে চেষ্টা করবেন, দেখবেন আপনাদের চোখে নজরুল সংগীত কে স্পষ্ট দেখতে ও উপলব্দি করতে সক্ষম হবেন, মনে রাখবেন যে নজরুল সংগীত উচ্চাংগ অংগের, তাই এর প্রতিটি শব্দে ও সুরে আলাপ, বিস্তার, তান-সার্গাম ও অলংকরণের চেষ্টা অজান্তেই এসে যায় একজন প্রকৃত, সুশিক্ষিত শিল্পী’র মনে-প্রাণে–হ্রদয়-জুড়ে এমনিতেই জেগে ওঠে সুরের মূর্ছনা–এর জন্য আদিযুগের অথর্ব, অযোগ্য শিল্পী দের(রেকর্ডকৃত অনেক শিল্পী’র গীত অনেক গানই শোনার অযোগ্য) অনুকরণে আমরা নজরুল-বিরোধি স্টাইল/গায়কী অলম্বনে এ যুগে এসে মুর্খে’র মত গান গাইতে পারিনা, অথবা বর্তমানকালে’র গৃহ শিক্ষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে নজরুল সংগীত এর কবর রচনা করতে পারিনা–আমাদের কে আরো সচেতন ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিজ স্বার্থ ত্যগ করে নিরপেক্ষ ভাবে নজরুল সংগীতে’র স্বার্থে সুবিচার করে সমস্ত জটিলতা থেকে মুক্ত হতে হবে।
মিন্টু রহমান, নজরুল একাডেমীর সাধারণ সম্পাদক এবং নজরুল সংগীতজ্ঞ।