মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমানঃ অত্যাচারী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন ভারতীয় মুসলিম নারীরা।
২০০ বছরের অধিক সময় অত্যাচারী বৃটিশরা ভারতের মাটিতে অনুশাসন চালিয়েছিল। ২০০ বছরের পরাধীনতার কঠিন জিঞ্জির ভেদ করে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষে যে স্বাধীনতার আলো এসে পৌঁছেছিল, তা ছিল শতসহস্র মানুষের ত্যাগ আর প্রাণ বিসর্জনের ফল।শৃঙ্খলতার কঠিন জালকে ছিন্ন ক’রে স্বাধীনতা আনতে যাঁরা ঝরিয়েছিলেন তাঁদের শেষ রক্তবিন্দু। নিঃশেষ করে ছিলেন তাঁদের দেহের অন্তিম শক্তিটুকুও। তাঁদের অবদানকে অস্বীকার করলে ভারতের স্বাধীনতাই আজ সম্পূর্ণ রূপে বৃথা হবে। ভারতকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে নিঃসংকোচে এগিয়ে এসেছিলেন এই সমস্ত মহান ব্যক্তিত্ব। ভারতের প্রত্যেকটি বালুকণায় রয়েছে এই শত সহস্র মানুষের ত্যাগের ছোঁয়া।
“কোন কালে একা হয়নিকো জয়ী পুরুষের তরবারী, প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয় লক্ষ্মী নারী।” -কাজী নজরুল ইসলাম
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে নারীরা অধিক সংখ্যায় অংশ গ্রহণ না করলেও তাঁরা এই আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন এটা বলা কোন দিক থেকেই যুক্তিযুক্ত হবে না। কিন্তু অধিক সংখ্যায় পুরুষদের অংশগ্রহণ কেবল নারীদের নিঃস্বার্থ ত্যাগেরই ফলাফল। অগণিত মুসলিম নারী স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। সঠিক তথ্য বিশ্লেষণের অভাবে আজ তাঁরা ঠাঁই পায়নি ইতিহাসের পাতায়। তাই তাঁরা আজ রয়ে গেছে দৃষ্টির অগোচরে।
১.বেগম হাজরত মহল:
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিম মহিলাদের ভূমিকার কথা আলোচনা করতে গেলে প্রথমে যাঁর নাম আসে তিনি হলেন বেগম হাজরত মহল। যিনি ছিলেন আওধারের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহের প্রিয়তমা স্ত্রী। বেগম হাজরত মহল স্বামীর কোলকাতাতে নির্বাসনের পর সক্রিয় ভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সিপাহী বিদ্রোহের সময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে অবশেষে তিনি পরাজিত হন। পরজিত হয়ে ব্রিটিশ সরকারের হাতে বন্দি হয়ে বশ্যতা স্বীকারের পরির্বতে তিনি ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপালে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ।
২.রিজিয়া খাতুন:
রিজিয়া খাতুন ছিলেন বাংলার প্রথম মুসলিম নারী যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন । যার ফলস্বরূপ তাঁকে অন্তিম নিঃশ্বাস পর্যন্ত কালাপানির নির্বাসন ভোগ করতে হয়েছিল।
৩.আবেদী বেগম:
যিনি সকলের কাছে ‘বি আম্মা’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন মুহাম্মদ আলী এবং সওকাত আলীর বৃদ্ধা মাতা। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যে বড়সড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অকপটে স্বীকার করতে হয়। তাঁর অবদানের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং গান্ধীজী বলেছিলেন, “তিনি বৃদ্ধা হলেও তাঁর মধ্যে ছিল যুবকদের ন্যায়ে অদম্য প্রাণ শক্তি।” ১৯২১সালে তাঁর দুই পুত্র মুহাম্মদ আলী এবং সওকাত আলীর ব্রিটিশদের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর চারিদিকে গুজব রটে যে তাঁর পুত্ররা ব্রিটিশদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্ত হয়েছেন। এই গুজবে উত্তেজিত হওয়ার পরিবর্তে দৃঢ কণ্ঠে উদ্ধৃতি দেন যে, তাঁর পুত্ররা হল ইসলামের সন্তান তাই তাঁরা কোনভাবেই ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তিলাভ করতে পারেন না। যদিও তা লাভ করে তাঁর হাতই তাঁদের উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার জন্য যথেষ্ট ।
৪.আজিজান:
এই মহীয়সী নারী ১৪৩২ সালে লক্ষ্ণৌ এ জন্মগ্রহণ করেন। তথ্যসূত্রে জানা গেছে তিনি উমরাও জানের সাথে সিরিঙ্গি মহলে বসবাস করতেন। ৪ই জুন ১৯৫৭ খ্রীঃ নানা সাহেব যখন যুদ্ধে যোগদানের আহ্বান জানান তখন তিনি গৃহত্যাগ করে তাঁর আহ্বানে সাড়া দেন। আজিজান অস্ত্র চালনায় যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। তাঁর অধীনে মহিলাদের একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে ওঠে। নির্ভিক এই মহিলা ব্রিটিশদের গোপন তথ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সরবরাহ করতে গিয়ে ইংরেজদের হাতে গ্রেফতার হন। তাঁকে জেনারেল হেভলকের সামনে উপস্থাপন করা হয় এবং তার সামনে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মুক্তিলাভ অথবা শহীদী মৃত্যু এই দু’টির একটি গ্রহণ করতে বললে তিনি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে গ্রহন করেন।
৫.জুবায়দা দাউদী:
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব মৌলনা সাফী দাউদীর স্ত্রী জুবায়দা দাউদী। যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুল কলেজের পড়ুয়ারা তাঁদের পঠনপাঠন বন্ধ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন তাঁদের জন্য মৌলনা সাফী দাউদী একটি শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত করে ছিলেন। এই শিক্ষা কেন্দ্রে জুবায়দা দাউদী একাত্মভাবে অংশগ্রহণ করে নিজেকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে উপস্থাপন করার সাথেসাথে নিজেকে মৌলনা সাফী দাউদীর সুযোগ্য স্ত্রী হিসাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
৬.সাদাত বানু কিছলু:
উর্দু ও পার্সি ভাষার সুখ্যাত কবি-প্রাবন্ধিক সাদাত বানু কিছলু ছিলেন ডাঃ সাইফুদ্দিন কিছলুর প্রিয়তমা স্ত্রী। যে সময় ভারতীয় সমাজে নারীর মত প্রকাশ ছিল সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ, সেই প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে সাদাত বানু কিছলু তাঁর কবিতার জ্বালাময়ী ভাষার মাধ্যমে ভারতীয় জনগণকে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। ১৯৯৬ সালে তাঁর স্বামী গ্রেপ্তার হন। এহেন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট শান্ত কণ্ঠে জানান, তিনি তাঁর স্বামীর ব্যাপারে যথেষ্ট গর্বিত কারণ, তাঁর স্বামীর এই গ্রেপ্তারী হয়তো সহস্রকোটি ভারতীয় নাগরিকদের পরাধীনতার গ্লানি ঘুচিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারবে। তাঁর স্বামীর তৈরি ‘স্বরাজ আশ্রমে’র তিনি একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন।
৭.জুলেখা বেগম:
তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রবীণ শিক্ষানবিশ এবং স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষা মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের সহর্ধমিনী। ভারতের মাটিতে স্বাধীনতা আনতে যথেষ্ট নির্ভিকতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন এই বীরঙ্গনা। ব্রিটিশদের হাতে আবুল কালাম গ্রেপ্তার হলে তিনি মৌলনার যোগ্য স্ত্রী হিসাবে নিজেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে পরিপূর্ণভাবে জড়িয়ে ফেলেন।
৮.নিশাতুন নিশা বেগম:
বেগম হাজরত মোহানী ১৯১৬ খ্রীঃ এপ্রিল মাসে প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে জনসম্মুখে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম স্বামী হজরত মোহানীর সাথে বিভিন্ন আলোচনা সভায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি আর্থিক অস্বচ্ছলতাকে দূর করার জন্য বিভিন্ন পত্রপত্রিকা বিক্রি করেন। বেগম হাজরত মোহানী বেগম খুরশিদ খাজার সাথে সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসে যোগদানের মাধ্যমে স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হন।
এছাড়াও মুনীরা বেগম (মওলানা মাজহারুল হকের স্ত্রী), আমিনা কোরেশি, ফাতেমা কোরেশি, আবুল খাত্তাবের স্ত্রী আমিনা তায়াবজী, আব্বাস তায়াবিজীর কন্যা রেহানা তায়াবজী, শামসুদ্দীন তৈয়বীর নাতি হামিদা তায়াবিজি, বেগম সখিনা লুকমান (বদরুদ্দিনের মেয়ে) তিতবি, ফাতেমা তৈয়ব আলী, শফাত তৌহিদ আলী, শহীদ অনাশা বিবি (লুৎফর মওলানা হাবিবুর রেহমানের স্ত্রী), সাফিয়া সাদ, বেগম কুলসুম শায়ানী, আসমত আরা খাতুন, সুঘ্রা খাতুন, বিবি আমাতুল ইসলাম, ফাতেমা ইসমাইল, সুলতানা হায়াত আনসারী, হাজরা বেগম, জুয়ার আনসারি- এই সমস্ত নারীরাও স্বাধীনতা আন্দোলনে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। চার দেওয়ালের মাঝে বদ্ধ থেকে নিজের পুত্র-স্বামীদের সর্বদা আন্দোলনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করার সাথে সাথে নীরবতার অবগুণ্ঠনকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের ওতপ্রোতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িয়ে তৎকালীন সামাজে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় রেখেছিলেন।আজ ভারতীয়রা সেই জীবন উৎস্বর্গ করা নারীদের উত্তরসূরীদের ধর্ষণ করছে, হত্যা করছে।