জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে কবিকে সন্মান সূচক ডি. লিট্ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারী বঙ্গভবনে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক উক্ত ডিগ্রী প্রধান করা হয়।
উল্লেখ্য যে, কবির অসুস্থতার করনে বেশ কয়েকবার তারিখ পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে সময় উপাচার্য ছিলেন ‘আবদুল মতীন চৌধুরী‘। কবির সমাবর্তন উৎসবে উপাচার্য ‘আবদুল মতীন চৌধুরী‘ যে গুরুত্ববহ মানপত্রটি পাঠ করেছেন তা সকলের সমীপে নিবেদন করছি।
মানপত্র :
দেশকালের জরা-শোক অবক্ষয়-অন্ধকারকে নীলকন্ঠের মতন ধারণ করে প্রজ্জলন্ত আকাক্ষার, আনন্দের, সংগ্রামের আরেঅকিত চেতনাকে যাঁরা বিশ্বলোকে পৌঁছে দিতে সক্ষম, তাঁরাই মহৎ। তেমনি এক মহৎ প্রতিভা আপনি, কাজী নজরুল ইসলাম। বিট্রিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণ-নিয়ন্ত্রিত বাংলার অসম্পূর্ণ পুনর্জাগরনের আহত সুফল (Sic) বাঙালী মধ্যবিত্ত শ্রেণী যখন নষ্ট ও স্বনে মজ্জমান, তাদের চেতনা-স্রোত যখন অন্ধকারবৃত্তে আবর্তিত, বাংলা সাহিত্যে তখন আপনার আবির্ভাব প্রমিথিউসের মতো।
আপনার অত্যুজ্জল আবির্ভাব বাংলা সাহিত্যের প্রাণে ও শরীরে সঞ্চার করেছিল বিপুল তারুণ্যের ঐশ্বর্য, যোগের আবেগ, গতির উচ্ছ্বাস, স্বাস্থ্যবান কল্পনার উদ্দামতা। আপনি কবি এবং আপনার কবিপ্রতিভার প্রাণশক্তি বাঙালি জীবনের বৃহত্তর ঐতিহ্যিক ঐক্যে ছিল প্রতিষ্টিত। সে কারনেই আপনার সৃষ্টি নিপীড়িত গনমানুষের আকাঙক্ষার, সম্ভাবনার, প্রতিবাদের, বিদ্রোহের ব্যতীক্রমী উচ্চারণ। আপনার সাহিত্যকর্ম সত্য-সুন্দর আর মানবতার উচ্চকন্ঠ-শিল্পরূপ। আপনি ছিলেন আপোষহীন সত্যসন্ধ কবি। বিট্রিশের রাজরোষ, কারাগার আপনাকে বন্ধী করেছে, কিন্তু অশুতোভয় আপনি দ্বিগুন আনন্দে প্রজ্বলিত হয়েছেন সত্যের সপক্ষে।

আপনি সর্বহারার সাম্যবাদী কবি, কল্যান আর প্রেম সাধনার কবি। তাই আজ আপনি জনগন প্রিয় কবি এবং আপনিই সমকাল ও শিল্পরীতির মাঝে ঘটিয়েছেন বিস্ময়কর এশান্ত সমন্বয়। কেবলমাত্র জীবনের বহিরঙ্গ সংলাপে নয়, অন্তরঙ্গ অস্তিত্বে আপনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। মানুষের ধর্মে, আত্নশক্তির আন্তর্জাতিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতায় – প্রবন্ধে-সঙ্গীতে আপনি তরুণ সমাজকে মানবতার উদার আদর্শে প্রাণিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাঙালি জাতির সামবপ্রদায়িক সঙ্কটে আপনার লেখনি ছিল সৃষ্টিশীল, ঐক্যবদ্ধ আত্নশক্তির উদ্বোধনে নিরলস। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আপনিই একমাত্র কবি-প্রতিভা, যিনি ঐতিহ্য সন্ধানে এরবং নির্মাণে ছিলেন স্বছন্দ, নির্দ্বন্ধ। হিন্দু ও মুসলমান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ঐতিহ্যকেই আপনি আপনার স্বয়ীও শাণিত চেুনার শব্দরূপে ব্যবহার করেছেন।
আপনার জীবনসম্পৃত্ত ঐতিহ্যবোধ, দর্ম-কথার সীমাবদ্ধতা থেকে ঐতিহ্যকে মুক্তি দিয়েছে। আপনি বাঙালি ঐহিত্যের পুনঃনির্মাতা, নব-ভাষ্যকার। আপনি ছিলেন শব্দের ধ্বনিগত ব্যবহারের বিস্ময়কর কারুশিল্পী গ্রন্থবদ্ধ এবং অভিজাত শব্দ-শৃঙ্ক্ষলিত সীমানাকে আপনি প্রসারিত করেছেন মৌলিক শব্দ-সম্ভারের এলাকায়, কখনো বা বিদেশী ভাষার সীমানায়। আপনার কবিত্ব প্রতিভার প্রবল আবেগে বিচিত্র-উৎসের শব্দাবলি ব্যঞ্জনায় হয়েছে পুষ্পিত সঙ্গীতজগতে আপনার অবদান অুুলনীয়, বিচিত্রধর্মী এবং স্বতন্ত্র। আপনার দেশাত্ববোধক সঙ্গীত সর্বকালের বাঙালিকে করবে উশুীপিত, উদ্বোধিত। আপনি কেবল বিপুল সংখ্যক গানের রচয়িতাই নন, সুরের সৃজনীশক্তিতে আপনি সঙ্গীত-জগতের নতুন পথনির্দেশক।
আজ আপনি বাংলাদেশের বিচিত্রমুখী সঙ্গীতের অনতিক্রমনীয় নিরিক্ষাধর্মী সার্থক সুরকার। আমাদের দুভার্গ্য, দীর্ঘ বত্রিশ বছর আপনি স্তদ্ধ। আপনার সাহসী অভিযাত্রী-মানসের সৃষ্টি ঐহিত্য থেকে আমরা বঞ্চিত। আপনার দু-দশকের সৃষ্টিসম্ভারের বৈচিত্র্য, বৈশিষ্ট এবং অভিনবত্বের উল্টরাধিকারের সৌভাগ্যে চিরকৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি নিয়ত প্রার্থনা করে যে, আপনি আবার সুস্থ হয়ে উঠুন। আজ আপনাকে সন্মান জানাবার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। সমাপ্ত।