কামাল আহমেদ: বৃষ্টিবিহীন কোনো এক পূর্ণিমা রাত। আকাশে থালার মতো বড় এক চাঁদ। গহীন অরণ্যে কোনো নৃজনগোষ্ঠীর মাটির ঘরের খোলা বারান্দায় বাঁশ-কাঠের বেঞ্চে বসে চাঁদদেখা, নৈশ-পাহাড়ীতে চোখ ডুবানো অথবা, স্বল্পকালিন শৈলনিবাসে গ্রীল ধরে একাকী দাঁড়িয়ে ঝিঁঝি ডাকা সন্ধ্যায় জোছনায় মন-ভেজানো, অজানা লোভে লোভে নিশিযাপন। এ দৃশ্য দেখার সাধ অনেক দিনের। তা আর হলনা কখনো। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, দিনেই জঙ্গলের গহীনে যাবো। হঠাৎ পরিকল্পনায় সঙ্গী জুটলো পনেরো থেকে ঊনিশ বছরের দশ কিশোর। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এই জঙ্গলের ঠিক মাঝামাঝি পশ্চিম দিক থেকে প্রবেশ করবো। গাইড হিসেবে সাথে রাখলাম জঙ্গলের পশ্চিম অংশের বাসিন্দা মুতালিব মিয়াকে। এ বন তার খুব পরিচিত। আমাদের এই পথটি আসলে স্থল নিকটবর্তী পাহাড়ি বাসিন্দারা অনুমোদনহীন কাঠ, ঘাস সংগ্রহে ব্যবহার করে। তাই এটি ছিল ঝুঁকিপূর্ণ, দূর্গম ও বেশি সময়ের। প্রথমবারের এডভেঞ্চার মানসিকতার কাছে ঝুঁকিটা উপেক্ষিতই ছিল।
রেমা-কালেঙ্গা জঙ্গলের নাম হয়তো আপনিও শুনে থাকবেন। সুন্দরবনের পর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়াও এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। আমার নিজ এলাকার এই বিখ্যাত বনাঞ্চল আমার কখনো দেখা হয়নি। আমার জন্য এটা লজ্জারও; কারণ এখানে সারা বছর, বিশেষতঃ শীতকালে দেশী-বিদেশী পর্যটকও আসে। সকাল ৯টায় যাত্রা শুরু হলো পায়ে হেঁটে। সাথে কিছু শুকনো খাবার ও পানির বোতল। ভাদ্র মাস, তাই বৃষ্টি, কাদা, জোঁক ও সাপের ভয় মাথায় ছিল। গভীর অরণ্যের চেয়ে পশ্চিম প্রান্তে উঁচু নীচু অসংখ্য টিলা রয়েছে। কয়েকটি টিলায় এখন মানুষ বসতি আছে। তারপর আর বসতি নেই। এই টিলার লালমাটির আঁকাবাঁকা রাস্তা এই বর্ষায় পাড়ি দেয়া কঠিন ও ঝুঁকির। বুনো গুল্মলতা আর লালমাটির পথের পাশে কখনো গুহার মতো কিছু দৃশ্যও চোখে পড়ে এইপথে।
কখনো পাথুরেমাটি, কখনো ঢালুতে কাদাজল মাড়াতে হল। পানিতে জোঁকের কামড়ও কেউ কেউ সহ্য করেছি। দু-তিন কিলোমিটার গভীরে বড় বড় গাছ আছে কিন্তু টিলা কম। যতই গভীরে যাচ্ছি, ক্লান্তি বাড়লেও এডভেঞ্চারও বাড়ছে। নানান প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ, বানর চোখে পড়লো। মাঝবনে দু-তিনটে বনবিভাগের ‘ভিলেজার’ পদবীর বনপ্রহরীর মাচার মতো প্রহরীচৌকি পেলাম। চৌকিতে কিছুটা বিশ্রাম ও পানি পান করলাম। আবারও পথচলা। কাছেই ছনবাড়ী বিট ও ছোট এক ত্রিপুরাপল্লী। এর আগেই নির্জন পাহাড়ে পাখির কিচিরমিচির আর ছোট একটি লেক চোখে পড়লো। হঠাৎ একদল বানর চোখের সামনেই ছুটোছুটি করল। পরক্ষণেই মুখপোড়া বানর দেখলাম। অল্পসময়েই চশমাপরা বানরও দেখা গেল। জঙ্গলের উচুঁ উচুঁ গাছগুলোর ডগায় বিকট শব্দে এক গাছ থেকে অন্য গাছে যাচ্ছে। এই এক অন্য রকম অনুভূতি। একটু এগোতেই আমাদের পাশের ঝোপঝাড়ে নড়াচড়া করছে কি যেন একটা। কিছু বুঝে উঠার আগেই আমাদের সামনে দিয়ে উড়ে চলে গেল একটা বনমোরগ। বনের ভিতর একটি খাল চোখে পড়লো যা আমাদের বেশ কয়েকবার পাড় হতে হয়েছিল। দেখলাম বিভিন্ন প্রকারের দেশীয় পাখি।
মোতালেব মিয়া বললেন, একবার শীতের সময় আসবেন তাহলে আপনাদের দেশীয় পাখির সাথে বিদেশী পাখিদের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিব। ২-৩ দিন সময় নিয়ে আসলে নাকি উল্লুকও চোখে পড়বে! একটি গাছের কোটরে চোখে পড়ল তক্ষক, যা অনেক বিশাল আকৃতির। গাছে গাছে চোখে পড়লো হরেক রকমের কাঠবিড়ালী।ছনবাড়ী থেকে উদ্ভিদ বৈচিত্র্য, উঁচু-নীচু পথ, কয়েকটি বড় বটগাছ দেখা হলো। ভারতীয় সীমান্ত নিকটবর্তী দেবরাবাড়ি ত্রিপুরা পল্লীর আগেই আরো একটি টলটলে জলের নির্জন প্রাকৃতিক লেক দেখে অবগাহন করতে ইচ্ছে হলো। ত্রিপুরাপল্লীতে এসে দেখলাম অনেকটি পরিবারের বসবাস। বাড়ির পাশে পাশে শুকরের খোঁয়াড় চোখে পড়ে। কথা হলো অতিবৃদ্ধ ত্রিপুরা সর্দার ও আরো ক’জনের সাথে। একটু উঁচুতে তেঁতুলতলায় বসে সঙ্গে রাখা শুকনো খাবার ও পানীয় গ্রহণ করলাম। ফিরতি-যাত্রা আরো এক দুর্গম পথধরে। দুর্গম জঙ্গলের নতুন বর্ণনা অনাবশ্যক। কেবল ‘লইক্ষ্যাছড়া’র লুকোনো সৌন্দর্যের টানেই এপথে এসেছি। ছড়ার বহমান পাহাড়ি পানিপথে হেঁটে হেঁটে বেশ গভীরে পৌঁছে গেলাম। এখানে পর্যটকরা সাধারণত দুর্গম বলে আসেননা। সৌন্দর্য দেখে বুঝেছি, না এলে কতটা মিস করতাম।নিশ্চয়ই আপনারও ইচ্ছে করছে এখানে আসতে। তা হলে ধারণা নিয়েই আসুন।
রেমা কালেঙ্গা অভয়ারণ্যঃরেমা–কালেঙ্গা বাংলাদেশের একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য যা সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলারচুনারুঘাট উপজেলায় অবস্থিত। এটি একটি শুকনো ও চিরহরিৎ বন এবং সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক বনভূমি। এছাড়াও এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বণ্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং জীব ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ বনাঞ্চল। রেমা–কালেঙ্গা অভয়ারণ্যের আয়তন ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর। বাংলাদেশের যে কয়েকটি প্রাকৃতিক বনভূমি এখনো মোটামু্টি ভাল অবস্থায় টিকে আছে, রেমা-কালেঙ্গা তার মধ্যে অন্যতম। এই অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির উদ্ভিদ, গাছ-পালা, লতা-পাতা আছে। উল্লেখযোগ্য উদ্ভিদগুলোর মধ্যে রয়েছে-আওয়াল, সেগুন, কাঁকড়, নেউড়, হারগাজা, গন্ধরই, হরীতকী, বহেরা, জাম ডুমুর, কাঠাল, চামকাঠাল, কাউ, কদম, রাতা, করাশি, চাপালিশ, নিম, বনমালা ইত্যাদি।
আছে ৭ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি। উল্লেখযোগ্য পাখিগুলো হচ্ছে-ভিমরাজ, পাহাড়ি ময়না, কাও ধনেশ, বনমোরগ, ফোটা কান্টি সাতভারলা, শ্যামা, শালিক, শামুক খাওরি, টুনটুনি ইত্যাদি। ৩৭ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য- কালো বন্যশুকর, সাদা বন্যশুকর, বানর, চশমা হনুমান, মুখপোড়া হনুমান, খরগোশ, ছোট হরিন, মেছোবাঘ, মেছোবিড়াল, উল্লুক প্রভৃতি। ভাগ্য ভালো থাকলে হরেক রকমের প্রাণীর দেখা পাবেন আপনি। ভিন্ন এক জগতের আবহ ভেসে উঠবে আপনার চোখের সামনে।রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমে আছে আধা ঘন্টা, এক ঘন্টা ও তিন ঘন্টার তিনটি ট্রেইল বা পথ। প্রতিটি ছবির মতো সুন্দর আর সাজানো। অভয়ারণ্যের ভেতরে আছে সুউচ্চ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের নিচেই আছে আঁকাবাঁকা একটি লেক।আসবেন কীভাবেঃবাংলাদেশের যেকোন প্রান্ত থেকে (বাসে/ট্রেনে) হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ আসতে হবে।
আসতে হলেঃ (যদি ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে আসেন) শায়েস্তাগঞ্জ রেল স্টেশন > শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রীজ(টমটম ১০টাকা)। শায়েস্তাগঞ্জ নতুন ব্রীজ>চুনারুঘাট মধ্যবাজার(সিএনজি ২০টাকা)। চুনারুঘাট মধ্যবাজার > কালেঙ্গা বাজার (সিএনজি ৭০টাকা)। কালেঙ্গা বাজার থেকে ১০-১৫ মিনিট হাঁটলেই রেমা-কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য মেইন গেট অব্দি চলে আসবেন। লেগুনা রিজার্ভ করতে চাইলে (শায়েস্তাগঞ্জ- কালেঙ্গা বাজার) দামাদামি করে নিবেন, সেক্ষেত্রে ভাড়া পরবে ১০০০-১২০০ টাকা। কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য ও করণীয়ঃ২০ টাকা করে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতেই স্বাগত জানাবে বিশাল বিশাল নাম না জানা গাছ। আপনারা রেমা কালেঙ্গা ঘুরতে আসলে অবশ্যই গাইড নিবেন, কারণ এটা অনেক বড় একটা বন,হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে এবং এর পাশেই রয়েছে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত। বাংলাদেশ বন বিভাগ থেকে অনুমোদিত ৩ জন গাইড আছে যারা পর্যটকদের পুরো বন ঘুরিয়ে দেখাবে। গাইড খরচ : ১০০০-১২০০ টাকা। এদের মধ্যে একজন – ফয়জুল্লাহ আল নোমানঃ ০১৭১২-৮৭৫২৩৩ / ০১৬৮৫-১১১২২০। রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘুরার জন্য সঠিক সময় শীতকাল (অক্টোবর-এপ্রিল মাস)।যে কোন পর্যটন স্পট আমাদের সম্পদ।
রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য বাংলাদেশের জাতীয় বনগুলোর মধ্যে অন্যতম, তাই এর পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব। আমরা ঘুরতে গেলে যেন এখানে সেখানে পলিথিন, বিস্কুট, চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল না ফেলি। স্থানীয়দের সাথে কোন ধরনের খারাপ আচরণ না করি। রাত্রিযাপন করতে হলেঃকালেঙ্গাতে থাকার জন্য সরকারি একটি ডাক-বাংলো আছে যেখানে থাকতে হলে জেলা প্রশাসক বা বন-বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। এছাড়া বেসরকারী তিনটি রিসোর্ট আছেঃ সিএমসি রিসোর্ট (শাহাদাত – 01719-470988), রেমা-কালেঙ্গা ইকো রিসোর্ট ও নিসর্গ রিসোর্ট। ভাড়া জনপ্রতি কমপক্ষে ১০০০ টাকা। তিন-চারজন হলে জনপ্রতি আরো কম পড়বে।খাবারঃ প্রয়োজনীয় ভালো শুকনো খাবার, পানীয় চুনারুঘাট থেকে আসার সময়ই নিয়ে আসতে পারেন। রিসোর্টে খেতে চাইলে গাইডকে আগে থেকে বলে রাখতে হবে।রিসোর্টের চারিদিকে ঝিঝি পোকার ডাক, নিস্তব্ধ বনে খুব সহজেই সন্ধ্যা থেকে রাত নেমে আসে। পরদিন খুব ভোরে পাখির কলকাকলিতে আপনার ঘুম ভাঙ্গবে। দিনেও যদি প্রকৃতির নির্জনতা উপভোগ করতে চান তবে আপনমনে নিঃশব্দে ঘুরতে থাকুন, সাবধানে। মাঝে মাঝে আপনার নির্জনতা ভেঙ্গে দিয়ে ডেকে উঠতে পারে জীববৈচিত্র্যের কোনো বুনো জন্তু অথবা হরেক পাখি। নগরজীবনের জন- কোলাহল ছেড়ে একটু নির্মল নিঃশ্বাস নিতে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও এখানে একবার এসেই দেখতে পারেন।