মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: আঘাত না পেলে বোধহয় বিশাল হওয়া যায় না। তার প্রমাণ মহা বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলামঃ-নজরুল ইসলাম এর মা জাহেদা খাতুন ছিলেন তাঁর বাবা কাজী ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী এমন কথা বলেও কবির পরিবার কে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছিল।সাধারণত মনে করা হয় দারিদ্র্যের প্রবল কষাঘাতে তার শৈশব পার হয় বলে তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। কিন্তু আসলে মা জাহেদা খাতুনের চার পুত্রের অকাল মৃত্যুর পরে নজরুল ইসলাম এর জন্ম হয় বলে শিশুকালেই তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। ছেলেবেলায় তিনি ‘তারা ক্ষ্যাপা’ নামেও পরিচিত ছিলেন। পরে ‘নুরু’ নামও তিনি ব্যবহার করেছেন।
সিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলের শিক্ষক এবং যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণ চন্দ্র ঘটক কিশোর নজরুলের মধ্যে স্বাধীনতা এবং বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার করেছিলেন। বিপ্লবী কর্মতৎপতার জন্য এক সময় এই শিক্ষকের বিচার হয়। আর বিপ্লবের সাথে যোগাযোগ আছে সন্দেহে দশম শ্রেণীর সেরা ছাত্র নজরুলের মাসিক ৫ টাকা হারে ছাত্রবৃত্তি কেড়ে নেওয়া হয়, যদিও পরে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় বৃত্তি পুনরায় অব্যাহত রাখা হয়। করাচি সেনানিবাসে কঠোর শৃংখলার মধ্যে থেকেও তরুণ নজরুল ইসলাম এর সাহিত্য-সংগীতে ছিলেন প্রাণবন্ত। হৈ-হুল্লোড়ে আসর জমাতেন বলে সেনানিবাসে তিনি “হৈ হৈ কাজী” নামে পরিচিত ছিলেন।
১৯১৯ সালের ২৮ জুন ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার প্রেক্ষাপটে ৪৯ নং বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে দেওয়া শুরু হলে নজরুল স্থায়ীভাবে করাচী ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। কলকাতায় এসে তিনি একটি মেসে ওঠেন। কিন্তু তিনি যে মুসলমান একথা জানতে পেরে মেসের চাকর তাঁর এঁটো বাসন ধুতে আপত্তি জানায়। এমতাবস্থায় দুইদিনের মাথায় তিনি মেস ছাড়তে বাধ্য হন। অবশ্য মেস ছাড়ার পরে তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসের একটি কক্ষে মুজফফর আহমেদের সাথে থাকা শুরু করেন। এই ব্যক্তি নজরুলের পরবর্তী ব্যক্তি জীবনে উল্লেখ্যযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। এই একই জায়গায় নজরুল আসার আগে থাকতেন বাংলা ভাষার আরেকজন প্রবাদপুরুষ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বাংলার অন্যতম প্রবাদপুরুষ। বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকার ব্যবস্থা হওয়ার দুইদিন পর জিনিসপত্র রেখে কবি চুরুলিয়া গ্রামের বাড়িতে যান। এই সময় মায়ের সাথে মান-অভিমানের কোনো ঘটনা ঘটে। এরপর মা জীবিত থাকা পর্যন্ত নজরুল আর চুরুলিয়া যাননি, এমনকি যাননি মায়ের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরও।
এরপর ১৯২১ সালের ৫ মে এক বিয়ের অনুষ্ঠানে সৈয়দা খাতুন নামের এক সম্ভ্রান্ত তরুণীর সাথে তরুণ নজরুলের পরিচয় হয়। সৈয়দা খাতুন ওই অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করেছিলেন। পরে তাকে আরো ভালোভাবে জানার সুযোগ হলে নজরুল তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এই আকর্ষণ তাঁদের বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে যায়, যদিও সে বিয়ে সফল হয়নি। পরবর্তীতে নাজরুলের দেওয়া ‘নার্গিস’ নামেই সৈয়দা খাতুন সবার কাছে পরিচিত হন।১৭ জুন, ১৯২১ সাল শুক্রবার গভীর রাতে নজরুলের সাথে নার্গিসের আকদ সম্পন্ন হয়। কিন্তু অত্যন্ত অভিমানী নজরুল একটি রাতও তার নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে পার করেননি। কনের মামা আলী আকবর খান কাবিননামায় জবরদস্তিমূলক শর্ত আরোপ করেন যে নজরুল নার্গিসকে দৌলতপুর ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না। অন্যায় এই বৈবাহিক শর্তে অপমানিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে নজরুল কনেকে গ্রহন না করে ভোর হবার আগেই চিরদিনের জন্যে দৌলতপুর ছেড়ে আসেন এবং পায়ে হেঁটে কুমিল্লায় পৌঁছান।
বিয়ে ভেঙ্গে গেলেও নজরুল কখনো এর জন্য নার্গিসকে দায়ী করেননি। জায়েদা খাতুন ওরফে নার্গিস এর সাথে নজরুল ইসলাম এর সংসার টিকে থাকলে আজ বাংলা সাহিত্যের চিত্র অন্য রকম হতো নিঃসন্দেহে।এখানেই হিন্দুস্থানের ষড়যন্ত্রের সফলতা।তিনি যা চান নি তাই করতে বাধ্য হয়েছেন। নার্গিসের সাথে বিয়ের রাতেই নজরুল অভিমানে ক্লান্ত মন নিয়ে কর্দমাক্ত পথে দশ-এগারো মাইল হেঁটে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপাড়ে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের বাড়িতে আসেন। এখানে বীরেন্দ্র সেনগুপ্তের জেঠাইমা গিরিবালা দেবীর কন্যা কিশোরী আশালতার (ডাক নাম- দুলি/দোলন এবং পরে নজরুলের দেওয়া নাম প্রমীলা) প্রতি নজরুল ইসলাম অনুরক্ত হয়ে পড়েন। হিন্দু মেয়ের সাথে মুসলমান যুবকের এই সম্পর্ক কুমিল্লার কিছু গোঁড়া হিন্দু এবং রক্ষণশীল মুসলমান সমাজ মেনে নেয়নি, তাই নজরুলকে বারবার কুমিল্লা ত্যাগ করতে হয়েছে।
বলা হয়ে থাকে নার্গিস এর সাথে বিচ্ছেদ হওয়ার পর কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই অসুস্থ কবির সেবাশুশ্রূষা করতে প্রমীলা দেবীকে উৎসাহিত করা হয়।অন্তরে এবং শরীরে অসুস্থ কবি প্রমীলা দেবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। অবশ্য আরো জানা যায় কবির জীবনের একটা পর্যায়ে নাকি জাহানারা চৌধুরী নামক এক অপূর্ব সুন্দরী মহিলার সাথেও তাঁর নিবিড় সম্পর্ক হয়েছিল । জাহানারা চৌধুরী রবি ঠাকুরের আশির্বাদ নিয়ে বর্ষবাণী বলে একটা বার্ষিকী কয়েক বছর চালিয়েছিলেন। জাহানারা ও নজরুলের মধ্যে পত্র বিনিময় হত। কবির অনেক পত্র ও কবিতা এই মহিলার কাছে ছিলো। তবু নজরুলের জীবন প্রমীলা ছাড়া শুধু অসম্পূর্ণই না, অসম্ভবও ছিলো।
এ সবই ছিলো হিন্দুস্থানের ষড়যন্ত্র।তবে প্রমীলা দেবী কবি কে জীবন দিয়ে যত্ন করেছেন।অসুস্থ অবস্থায় ও বিছানায় শুয়ে শুয়ে কবিকে খাইয়ে দিয়েছেন এমন দৃশ্য ছবিতে দেখা যায়। সেই ছবি কে তুলেছিল তা জানা যায় নি। ‘যুগবাণী’র জন্য রাজদ্রোহমূলক প্রবন্ধ লেখা ও প্রচারণার অভিযোগে কবি গ্রেফতার হন ১৯২৩ সালে । হুগলীর জেলে নজরুল ৩৯ দিন কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা, অবমাননামূলক আচরণ ও নির্যাতনের প্রতিবাদে আরো ২১ জন সহবন্দির সাথে অনশন ধর্মঘট পালন করেন। এসময় তার শারীরিক অবস্থার মারাত্মক অবনতি হওয়ায় তা তাঁর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের গভীর চিন্তার মধ্যে ফেলে। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কালিম্পং থেকে নজরুলকে অনশন ভাঙ্গার অনুরোধ করে টেলিগ্রাম করেছিলেন, “Give up hunger strike, our literature claims you.” যদিও ব্রিটিশ সরকার সে বার্তা নজরুলের কাছে পৌঁছুতে দেয়নি ।