বিশ্ব পর্যটন দিবস-২০২১
মোহাম্মদ কামাল আহমেদ: হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট- বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বিবেচনায়, ঐতিহাসিক গুরুত্বে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, নদী, পাহাড়-টিলা, বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি, সুদৃশ্য চা-বাগান,রাবার বাগান, দীঘি-জলাশয়ের প্রাচুর্যে প্রাকৃতিক নৈসর্গ ঘেরা বহুমাত্রিক বৈশিষ্টের অধিকারী বিবেচনায় পর্যটন শিল্প বিকাশের জন্য অতি সম্ভাবনাময় একটি উপজেলা। এছাড়াও দেশের প্রাচীনতম ভূমি-বৈচিত্রের এক গৌরবময় ঐতিহ্যও রয়েছে এই চুনারুঘাটের, রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক নবোপলীয় যুগের মানববসতির ইঙ্গিতবাহী প্রত্নসম্পদ ।
প্রাচীনকালে অর্থাৎ উপমহাদেশের মুসলমান আগমনের আগেই ‘রাজপুর’ নামে এক ক্ষুদ্র হিন্দুরাজ্যপাটের অস্তিত্ব থাকায় এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে ‘তরফ’ নামে মুসলমান রাজ্যপাটের রূপান্তরের মতো এক বিশাল ঐতিহাসিক ও সুমহান ঐতিহ্য বহন করছে এই অঞ্চল। আশেপাশে আছে মুসলিমসভ্যতা বিকাশকালের স্থাপত্যরীতির পুরাকীর্তি। ধর্মীয় ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবগাম্ভীর্যের নিরিখে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট একটি অতি পবিত্রস্থান।
সুফীসাধক হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অনুগামী সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (রঃ)এর পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত প্রায় শতকিলোমিটার দীর্ঘ খোয়াইনদী ছাড়াও- করাঙ্গী, সুতাং, কুলিয়াছড়া, লক্ষ্যাছড়া, ইছালিয়াছড়া, ভূঁইছড়া প্রভৃতিবিধৌত চুনারুঘাট একটি ঐতিহাসিক জনপদের নাম। আশেপাশেই রয়েছে ষোড়শশতকের বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীদের তীর্থভূমিসমূহ। নিকটবর্তী হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় উচাইল মসজিদ একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন।
আরও রয়েছে- চুনারুঘাটের ৩ নম্বর ইউনিয়নের চান্দপুর বাগানের পাশে প্রস্তাবিত এক অর্থনৈতিক অঞ্চল, ১নম্বর গাজিপুর ইউনিয়নের বাল্লা-সীমান্ত এলাকায় প্রস্তাবিত স্থলবন্দর, সাদাবালি-সিলিকা-বালির আধিক্যতা। রয়েছে বিশাল বিশাল আয়তনের ১৩টি চাবাগান, রয়েছে সাতছড়ি জাতীয়উদ্যান এবং রেমাকালেঙ্গা অভয়ারণ্য- বিরল প্রজাতির পশুপাখিদের অবাধ বিচরণভূমি ও বাংলাদেশের একমাত্র ভার্জিনফরেস্ট।
বর্তমান সরকার ২০২১ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিনত করার লক্ষ্যে কাজ করেযাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাকে পর্যটনে আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণকরা হয়েছে । বিশেষ একটি বিষয়ের ব্র্যান্ডিংকরার মাধ্যমে দেশেবিদেশে পরিচিত করার লক্ষ্যে হবিগঞ্জ জেলাকে বাংলাদেশের অন্যতম একটি পর্যটনজেলা হিসেবে গড়েতোলার জন্য জেলা-ব্র্যান্ডিংএর জন্য এ জেলার রেমাকালেঙ্গা অভয়ারণ্যকে নির্বাচনকরা হয়েছে। তা আমাদের গৌরবের।
জাতীয় পর্যটন নীতিমালা ২০১০ এর মাধ্যমে পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষনাকরা হয়েছে।জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ পর্যটনকর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন, তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ট্যুরিজমবোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং ঢাকা আগারগাঁতে দৃষ্টিনন্দন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের নিজস্বভবন নির্মান করেছেন, যা প্রশংসার দাবিদার।
২০১৬-২০১৮ সালকে পর্যটনবর্ষ ঘোষণাকরে নানা উদ্যোগ এবং পরিকল্পনা গ্রহণকরা হয়। ২০০৯ সাল থেকে গত ৯ বছরে ৬ হাজার ৬৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বর্তমানে দেশের পর্যটন খাত জিডিপিতে ২ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখছে।
পর্যটনমন্ত্রণালয় সূত্র থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের পর্যটনখাতে প্রত্যক্ষকর্মসংস্থান হয়েছে ১১ লাখ ৩৮ হাজার ৫০০জনের। পরোক্ষকর্মসংস্থান হয়েছিল ২৩ লাখ ৪৬ হাজার, যা মোটকর্মসংস্থানের ৪ দশমিক ১ শতাংশ। ওয়ার্ল্ডট্রাভেল অ্যান্ড টুরিজম কাউন্সিল এর পূর্বাভাস হচ্ছে, গড়ে ১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়ে এইসংখ্যা ২০২৬ সালে ২৮ লাখে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড সূত্র থেকে জানাযায়, ট্যুরিজম সংশ্লিষ্ট এবং অ্যাভিয়েশন খাতে ২০১৪ সালে যাত্রী ছিলো ৯০ লাখ। ২০৩৫ সালে এইসংখ্যা পৌঁছুবে ২২ কোটি ১০ লাখ। ২০১৪ সালে এইখাতে কর্মসংস্থান হয়েছিল ১৩ লাখ। ২০৩৫ সালে ১৪৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধিপেয়ে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ৩৩ লাখ। ২০১৪ সালে এইখাত থেকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) যুক্ত হয়েছিলো ৩ বিলিয়ন ইউএস ডলার। ২০৩৫ সালে ১৪২ শতাংশ হারে বৃদ্ধিপেয়ে দাঁড়াবে ৮ বিলিয়ন ইউএসডলার।
২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর- এর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া লিখিত প্রবন্ধ-‘পর্যটন শিল্পের বহুমাত্রিকতা ও সম্ভাবনা’তে জানতে পারি- পর্যটন শিল্প পৃথিবীর একক বৃহত্তম শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। পর্যটনের গুরুত্ব সর্বজনীন। পৃথিবীর প্রায় সব দেশে পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত। ১৯৫০ সালে পৃথিবীতে পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৬ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে।
ধারণা করাহচ্ছে, এবছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারাপৃথিবী ভ্রমণ করবেন। অর্থাৎ বিগত ৬৭ বছরে পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পর্যটকসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে। পর্যটনের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়েথাকে। ২০১৭ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৭ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয়হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার।
আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। পর্যটনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি খণ্ডচিত্র আমরা এরথেকে পেতেপারি। সারা বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এশিল্পে কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশের জিডিপিখাতে পর্যটনশিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এখাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটনখাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা।
তাছাড়া সঠিক তথ্য-উপাত্ত না পাওয়া গেলেও ধারণা করাহয়, গতবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশিপর্যটক ভ্রমণ করেন। একইবছর প্রায় ৪ কোটি দেশীয়পর্যটক সারা বাংলাদেশ ঘুরে বেড়ান।উল্লিখিত সকল তথ্য-উপাত্তের নিরিখে সহজেই বুঝাযাচ্ছে, বিশ্বে পর্যটনখাত অন্যতম আকর্ষণীয় ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির খাতে পরিণত হচ্ছে দিনদিন।
বাংলাদেশ যদিও এক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে তবুও প্রচেষ্টার কমতি নেই; কেবল স্থান, কাল বুঝে সঠিক স্পট নির্বাচন করে যুতসই উদ্যোগের ও পরিকল্পনার ঘাটতি কাটাতে পারলেই সম্ভাবনার সোনালী-দ্বার খোলে যাবে। এ বিবেচনায় হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটসহ আশপাশ নিয়ে অঞ্চলটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি পর্যটন বিষয়ক উদ্যোগসমূহ চুনারুঘাটকে সম্ভাবনাময় স্পট বিবেচনায় নিলে এবং পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়িত হলে পর্যটন শিল্পের এক বিপুল সম্ভাবনাময় দ্বার উম্মুক্ত হবে বলে আমরা বিশ্বাসকরি। চুনারুঘাট- গুরুত্ব পেলে, কার্যকর পদক্ষেপ নেয়াহলে, পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে-এমন স্পট সমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরছি:প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নবস্তু- হাতিয়ার ও চাকলাপুঞ্জী:চুনারুঘাটের মাটি কোটিবছরের পুরনো।
বর্তমানকালের দেশের মোটভূমির অতি অল্পই এতোটা প্রাচীন। ধারণা করাহচ্ছে- নব্যপ্রস্তর যুগে অর্থাৎ ৩৫০০ বছর আগেও চুনারুঘাটে মানুষের বসবাস ছিল, তাও হয়তো অনেকেই জানিনা। আগেই জেনেছি, বর্তমান বাংলাদেশের সমুদয় ভূমির মাত্র ১২ শতাংশ যখন গঠিত হয় তখনই চুনারুঘাটের তরফ ও রঘুনন্দন পাহাড় মাথা উঁচু করে বিদ্যমান ছিল। এপর্যন্ত প্রাপ্ত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত্বের ভিত্তিতে এবং প্রত্ননির্দশনের রেডিওকার্বন তারিখ নির্ণয় করে ভারতবর্ষে আদি মানববসতির বিভিন্ন ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, যার কিছু কিছুতে আমাদের এ অঞ্চলের সংশ্লিষ্টতাও খুঁজেনেয়া যেতেপারে।
মাত্র কয়েক বছর হল, চুনারুঘাটের চাকলাপুঞ্জিতে প্রাপ্ত প্রাগৈতিহাসিক শিকারজীবি মানুষের ব্যবহৃত নিদর্শন এ অঞ্চলে প্রাচীন মানববসতির গবেষণার নতুন দ্বার উন্মোচিত করেছে।মুস্তাকীম আহমদ চৌধুরীর ‘হবিগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থে আছে, ‘এ অঞ্চল (চুনারুঘাট) প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত ছিল।… ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে চুনারুঘাটের কাছে অনুসন্ধানকার্যের ফলে একটি প্রাগৈতিহাসিক প্রত্নস্থল আবিস্কৃত হয়।..চাকলাপুঞ্জির বালুনদী থেকে সর্বমোট ৮৩টি প্রত্নবস্তু সংগৃহীত হয়।…প্রাপ্ত হাতিয়ারগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রমাণকরে এগুলো নব্যপ্রস্তরযুগে তৈরি হয়েছিল।’উল্লিখিত বিষয়ে কার্যকর অগ্রগতি সাধিত হলে পর্যটক আকৃষ্ট হবেই।
রেমাকালেঙ্গা অভয়ারণ্য :রেমাকালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার অন্তর্গত গাজীপুর, রাণীগাঁও ও মিরাশী ইউনিয়নে অবস্থিত। এই অভয়ারণ্যটির দক্ষিণ পশ্চিম দিকে রেমা চাবাগান , পূর্বদক্ষিণ দিকে ভারতীয় ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তর ও পশ্চিমদিকে তরফপাহাড় সংরক্ষিত বন অবস্থিত ।

এটি মূলতঃ তরফপাহাড় সংরক্ষিত বনের অংশ । অভয়ারণ্যটি বন্যপ্রাণীসংরক্ষণ আইন অনুসারে ১৯৮২ সালে ১০৯৫.০০ হেক্টর এলাকাকে নিয়ে প্রথমেই প্রতিষ্ঠা করাহয় । পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে একে সম্প্রাসরণ করে ১৭৯৫.৫৪ হেক্টর করা হয় । একাধিকবার সম্প্রসারণে সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ বর্তমানে এর আয়তন ৬০০০ হেক্টর। রেমাকালেঙ্গা অভয়ারণ্যটি বিরলপ্রজাতির পশুপাখিদের বিচরণভূমি ।
সীমান্তবর্তী রেমাকালেঙ্গা টাওয়ার থেকে ভারতের ত্রিপুরারাজ্য ও বনের দৃশ্য উপভোগ করা যায়। কোথাও কোথাও এটিকে বাংলাদেশের একমাত্র ভার্জিন-ফরেস্ট হিসেবে বলাহয়েছে। এর বিশাল আয়তন ও জীববৈচিত্র্য পর্যটককে বিশেষ আকর্ষণ দিতে সক্ষম। রেমা-কালেঙ্গার বর্তমান অভয়ারণ্যের ভিতর প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালার পরিমান ৯১% এবং রোপিত গাছপালার পরিমান প্রায় ৯% । অভয়ারণ্যে ৬৩৮ প্রজাতির গাছপালা ও লতাপাতার আবাসস্থল রয়েছে।
জীববৈচিত্রপূর্ণ এ প্রাকৃতিক বনে চিরহরিৎ,পর্ণমোচি, বাঁশ ও গুল্মলতা ইত্যাদি বিভিন্নস্তরের গাছ মিশ্রঅবস্থায় রয়েছে । স্থানীয়প্রজাতির বৃক্ষ রয়েছে, এদেরমধ্যে আওয়াল, কাকরা, নেউর, হারগাজা,গন্ধরাই, হরিতকি, ,বহেরা, জাম, ডুমুর, জারুল, কাউ, কদম, রাতা, গামার, বনাক চিকরাশি, গর্জন, চাপালিশ, নিম, সিভিট, শিমুল, কড়ই প্রভূতি উল্লেখযোগ্য বৃক্ষদ্বারা এ প্রাকৃতিকবন সমৃদ্ধ।
অভয়ারণ্য ১৭ প্রজাতির উভচর, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ১৬৭ প্রজাতির পাখি, যেমন- ভিমরাজ, পাহাড়িময়না, কাওধনেশ, বনমোরগ/মুরগী, লালমাথা ট্রগন, ফেটাকন্টী ,সাতভায়লা, টিয়া, ঘুঘু, শ্যামা ইত্যাদি। বন্যপ্রাণীর মধ্যে বেজি, বড়কাঠবিড়ালি, বনশুকর, বানর, চশমাপড়া হনুমান, মায়াহরিণ, গন্ধগোকুল, মেছোবাঘ, চিতাবাঘ,মুখপোড়া হনুমান, লজ্জাবতীবানর উল্লেখযোগ্য ।
৩৭ জাতের স্তন্যপায়ী প্রাণী ও বিলুপ্ত প্রায় শকুনপ্রজাতি রয়েছে এখানে। বাংলাদেশে ২টি শকুনের নিরাপদ এলাকা চিহ্নিতকরা হয়েছে । এর একটিহলো এই রেমা-কালেঙ্গা বনাঞ্চল। রেমা-কালেঙ্গার মতো সমৃদ্ধবনাঞ্চল দেশেরমধ্যে বড় গৌরবের কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সেই গৌরবের স্থান ম্লান হয়ে আছে।

সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান: ২০০৫ সালে প্রায় ২৪৩ হেক্টর জায়গা নিয়ে সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় রঘুনন্দন পাহাড়ে সাতছড়ি জাতীয়উদ্যান প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা সাতছড়ি জাতীয়উদ্যানে অবস্থিত সাতটি পাহাড়িছড়া বা ঝর্ণা থেকে এই স্থানের নামকরণ করাহয় সাতছড়ি। পূর্বে সাতছড়ি জাতীয়উদ্যান ‘রঘুনন্দনহিল রিজার্ভফরেস্ট’ নামে পরিচিত ছিল।
সাতছড়ি জাতীয়উদ্যানের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৪৫ প্রজাতির নানাজাতের গাছপালা। এছাড়া এই বনভূমিতে ৬ প্রজাতির উভচরপ্রাণী, ১৮ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪ প্রজাতির স্তন্যপায়ী এবং প্রায় ১৪৯ প্রজাতির পাখি রয়েছে। প্রাণীর মধ্যে সাতছড়ি জাতীয়উদ্যানে দেখামিলে মেছোবাঘ, উল্লুক, মুখপোড়া হনুমান, শুকুর, লজ্জাবতী বানর, চশমা হনুমান এবং নানা প্রজাতির সাপ। পাখিদের মধ্যে রয়েছে লালমাথা ট্রগন, ধনেশ, ঘুঘু, টিয়া, ঈগল, ময়না ইত্যাদি।
সাতছড়ি জাতীয়উদ্যানের চারপাশে ৯টি চাবাগান, আদিবাসী ও স্থানীয়গ্রাম এবং ফসলিজমি রয়েছে।রেমা-কালেঙ্গার মতোই এখানে পর্যটক আকর্ষণের মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। রেমা-কালেঙ্গার তুলনায় যোগাযোগ ভালো থাকায় এখানে পর্যটক অনেক বেশি।
খাসিয়াদের পানপুঞ্জি: হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাটের তরফপাহাড়, রঘুনন্দনপাহাড় ও এর পার্শ্ববর্তী বাহুবল উপজেলায় পানির ছড়াগুলোকে কেন্দ্র করে খাসিয়া নৃ-গোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের বসবাস। এদের জীবনযাপন বৈচিত্রপূর্ণ। এ নৃ-গোষ্ঠী মূলত: পান, সুপারি, বিভিন্নজাতের মসলা, কমলালেবু চাষাবাদ করে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালিত করছে।
খাসিয়া পুঞ্জিকে কেন্দ্রকরে পযটনশিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। খাসিয়া পান পযটকদের আকর্ষনীয় একটি বিষয় হতেপারে । এ উপজেলার পাহাড়ের ছোট ছোট টিলায় খাসিয়ারা বসবাস করে থাকে। টিলার ভাঁজে ভাঁজে খাসিয়ারা উৎপাদন করে এই পান। বাহুবল ও চুনারুঘাট উপজেলায় ১৪.০ হে: জমিতে ৩৫৯৯ কুড়ি পান উৎপন্ন হয়।
চুনারুঘাট-বাহুবল ও হবিগঞ্জ জেলার অন্যান্য এলাকায় রয়েছে খাসিয়া পানের শতাধিক পুঞ্জি।চা-বাগান:চুনারুঘাটেই রয়েছে ১৩ টি চা-বাগান; যা উপজেলার মোট আয়তনের বিশাল এক অংশ। ১৩টি চা বাগানের উঁচু-নীচু টিলা, সর্পিল ভঙ্গি, নয়নাভিরাম সবুজের ঢেউ- সব মিলিয়ে উপজেলার নৈসর্গিক শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে। চাবাগান গুলোতেও প্রতিদিনই পর্যটক আসেন। মুড়ারবন্দ: চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতাব্দীর তরফ-যুগের বহু স্মৃতিচিহ্ন এখনো এখানে বিদ্যমান; যা তৎকালীন মুসলিম শাসকদের, ধর্মপ্রচারকদের, দিব্যশক্তিধারী মহানপুরুষদের চিন্তা-চেতনা, কর্ম ও ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়।
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দিন (র:) এর সঙ্গী বারো আউলিয়াদের কেউ কেউ, সৈয়দ বংশীয় বহু ওলি আউলিয়া, বহু কামেল পুরুষগণ এই মুড়ার বন্দের সুশীতল জামের ছায়ায় শুয়ে আছেন। এখানে এখনো প্রতিদিন সারা দেশ থেকে বহু ভক্তগণ আসা-যাওয়া করেন। বাৎসরিক ওরশ আরো ঝাঁকজমকপূর্ন হয়।
প্রাচীন পূণ্যসলীলা খোয়াইনদী: অচ্যুতচরন চৌধুরীর ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ তে আছে, প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্র- বায়ুপুরাণ, তীর্থচিন্তামনি প্রভৃতি গ্রন্থে শ্রীহট্টের যে ৩টি প্রাচীন নদীকে পূণ্যসলিলা আখ্যা দেয়া হয়েছে তা হলো, বরবক্র (বরাক), মনু ও ক্ষমা (খোয়াই)। এই প্রাচীন খোয়াই নদী ত্রিপুরা থেকে চুনারুঘাটের ভেতর দিয়ে হবিগঞ্জের নবীন প্লাবন সমভূমিতে পতিত হয়েছে; যা প্রায় শত কিলোমিটার পথ অতিক্রম তরেছে।
ক্ষুদ্র জাতিস্বত্ত্বা ও চা শ্রমিক: কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাসও আছে। সাতছড়ি ও কালেঙ্গা পাহাড়ি অঞ্চলে কিছু আদিবাসী আছে। এ ছাড়া ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৪০ সালের পর চা শ্রমিক ও রেললাইন স্থাপনের জন্য কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে চা বাগান এলাকায়। চুনারুঘাটের ১৩টি চা বাগানে এদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। এরা উড়িষ্যা, নাগাল্যাণ্ড, নাগপুর, ছোট নাগপুর, বিহার, সাঁওতাল পরগণা, উত্তরপ্রদেশ, ভোজপুর, অন্ধ্রপ্রদেশ প্রভৃতি দরিদ্র অঞ্চল থেকে এসেছিল।
তবে চাবাগানে বসবাসরত চুনারুঘাটের যে সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস তাদের মধ্যে খাসিয়া, ত্রিপুরা, সাঁওতাল, তেলেগু, খাড়িয়া, বাউরী, বাগতি, রিকমন, রিকিয়াসন, মাহাতি, ওঁরাও, মুণ্ডা, রাজবংশী, তাতী, ভুমিজ, গোয়ালা, ঝরা, বাড়াইক, সাধু, ঘোষ, কৈরি, কালিন্দী, চৌহান, রবিদাস, উড়িয়া, তন্তুবায়, রুদ্রপাল, কন্দ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
এদের বিচিত্র জীবনধারাও পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে বলে মনেকরি। মনিপুরী জীবন ও সংস্কৃতি:এছাড়া চুনারুঘাটের আবাদগাঁও, উসমানপুর, গাজীপুর, ছয়শ্রী, ইকরতলি, ঘনশ্যামপুর প্রভৃতি গ্রামে ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠী মনিপুরী সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। চুনারুঘাটের সাথে এদের আত্মিক সম্পর্ক ১৬০৬ সাল থেকে। চুনারুঘাটে তাদের আগমন অনেক পরে।
জানা যায়, ১৮১৯ থেকে ১৮২৬ খ্রিঃ পর্যন্ত মনিপুর-বার্মা যুদ্ধ কালিন সময়ে চুনারুঘাটে তাদের আগমন।এরা এক বিচিত্র ও উন্নত গীত-নৃত্য সংস্কৃতির ধারক।
চুনারুঘাট পুরাতন খোয়াই: চুনারুঘাট পৌরসভায় পুরাতন খোয়াইনদী ঘিরে মফস্বল শহর পার্শ্বে চমৎকার এক পার্ক, ক্ষুদ্র নৌ-বিহার, লেক তৈরি করা যেতে পারে। যা শিশুদের জন্য বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে। গ্রীণল্যান্ড পার্ক: ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা গ্রীণল্যাণ্ড পার্কও চুনারুঘাটে বিনোদনের একটি কেন্দ্র হিসেবে ইতিমধ্যেই পরিচিতি পেয়েছে। পরিচর্যা পেলে তা আরো আকর্ষনীয় হতে পারে।

দমদমিয়া বিল: এটি চুনারুঘাটের ভারত সীমান্ত ঘেঁষেই নালুয়া বাগানের একটি বিল। এর স্বচ্ছজল, পদ্মফুল, সৌন্দর্য মানুষকে আকৃষ্ট করে। প্রতিদিন বহু পর্যটক সেখানে আসে।
পানছড়ি লেকভিউ: রঘুনন্দন পাহাড়ের কূলঘেঁষে এটি গড়েউঠছে। কাজ সম্পন্নহলে আশাকরি বিনোদনের কেন্দ্র হয়ে উঠবে এটি।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল : চান্দপুর চা বাগানের পাশে বিশাল এলাকা নিয়ে এক নয়নাভিরাম বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন আছে। বাস্তবায়ন হলে এলাকার আর্থিক গতিময়তার সাথে পর্যটক আকর্ষণও বাড়বে।
বাল্লা স্থলবন্দর: বাংলাদেশ -ভারত সীমান্ত বাণিজ্য প্রসারে বিশেষ একটি কেন্দ্র হিসেবে বাল্লা স্থলবন্দর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে। বিবেচনায় রাখলে সেটাও পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে। অনেক আশাবাদ যে, বক্তব্য বিষয়ের প্রত্যেকটি পর্যায়ে সরকারি পর্যটন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গুলোর সুদৃষ্টি আকৃষ্ট করতে পারলে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হলে চুনারুঘাটকে নবরূপে সাজানো সম্ভব। বিশ্বে ভারত সহ বহু দেশে দৃষ্টিনন্দন পর্যটন নগরী ও শৈলনিবাস গড়ে উঠেছে।

আমি মনেকরি হবিগঞ্জ জেলার প্রাচীনতম ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক এই চুনারুঘাট উপজেলাকে সরকারের পর্যটন বিষয়ক উদ্যোগ ও নীতিমালার আওতায় এনে, বিশ্বপর্যটন শিল্পের নতুন নতুন ধারণার আলোকে সাজিয়ে তোলা হলে চুনারুঘাটকে একদিন সারা পৃথিবী চিনবে। চুনারুঘাট হয়ে উঠতে পারে এক আধুনিক শৈলশহর ও শৈল্পিক পর্যটন নগরী। এমন উঁচু-নীচু, পাহাড়-সমতল, নিকটেই সমূদ্রসদৃশ নিম্নাঞ্চল ও বহুজাতিক জীবনবৈচিত্র এক জায়গায় এভাবে পাওয়া বিরল।