শিবলী সাদিক: পোল্যান্ড! ইউসুফ চাদিদ , এই পোল্যান্ডেরই পোজনান মসজিদের ইমাম ! !
মুসলিম নাগরিক সমিতির প্রধান টমাস মিস্কোভিচ এই পোল্যান্ডেরই ! ! !
আর আছেন আগাটা নালবোরচিক, ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামতত্ববিদ ! ! ! !
১০ বছর ধরে পোলিশ ক্যাথলিক গির্জার ক্যালেন্ডারে ২৬ জানুয়ারি দিনটি ইসলাম দিবস হিসাবে জায়গা করে নিয়েছে৷
এই পোল্যান্ডেই মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করছেন আর্টুর কনোপাকি৷
প্রায় ১,০০০ বছর আগে পিয়াস্ট রাজবংশের অধীনস্থ রাজ্য হিসাবে পোল্যান্ড সর্বপ্রথম সংগঠিত হয়। ষোড়শ শতকের শেষভাগকে পোল্যান্ডের স্বর্ণযুগ বলা হয়, যখন জাগিয়েলনীয় রাজবংশের অধীনে পোল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ, সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৭৯১ সালে পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া কমনওয়েলথের সংসদ, যা সেইম নামে পরিচিত, ইউরোপ মহাদেশের প্রথম রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন সংবিধানের আদলে একটি সংবিধান রচনা ও প্রবর্তন করে। কিন্তু এর অল্প কিছু কাল পরেই পোল্যান্ডের প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া পোল্যান্ডকে গ্রাস করে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর পোল্যান্ড আবার স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর অবশ্য পোল্যান্ড তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনত কমিউনিস্ট রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী পোল্যান্ড এ পরিণত হয়।

রিবনিক:
রিয়াল মাদ্রিদ এবং পোলিশ ন্যাশনাল ফুটবল দলের গোলরক্ষক জেরী ডুডেক এর রিবনিক, রুদা নদীর তীরে তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার পরিবেশ থাকাতে “সবুজ” শহর খ্যাতি ভোগ করছে পোল্যান্ডের যে শহরটি , তারই নাম রিবনিক।
জার্মান রাজনীতিবিদ অটো লন্ডসবার্গের রিবনিক, ১৯৪৫ থেকে ১৯৮৯ পোল্যান্ডের কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে থেকে শহরটিকে দক্ষিণ পোল্যান্ডের একটি প্রধান খনির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়েছিল।
পোলিশ পিয়ানোবাদক পিয়াত পেলেকজানি আর লিডিয়া গ্রিসোলোনিয়ার রিবনিক যেখান থেকে ১ থেকে ২ ঘন্টার ড্রাইভ করলেই পাওয়া যাবে বেজিকিডি পর্বতমালা, স্কিইংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় বিনোদনমূলক এলাকা।
পোলিশ ফুটবলার Krzysztof বডিজিওনি এই রিবনিকেরই !
ক্রিগ্মামারিনে অ্যাডমিরাল হারমান বোহেম ও কিন্তু এই রিবনিকের ! !
২০০৮ সালের বিজয়ী সুপারস্টার টমাস গদজ এই রিবনিকের ! ! !
অভিনেতা ওলেক কাপ্পাও এই রিবনিকের ! ! ! !
এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন থেকে পোল্যান্ডের একটি সীমান্তবরতী ( চেক রিপাবলিক ও স্লোভাকিয়া) শহর রিবনিকের এই হিচ হাইকিং ( বাই রোড) থেকেই আমি এস্তোনিয়ান, লাটভিয়া্ন, লিথুয়ানিয়ান আর পোলিশ জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সম্পর্কে আর এই দেশগুলোর বিশালতা, ভউগোলিক দর্শনীয় স্থান আর সংস্কৃতি সম্পরকে অভিজ্ঞতা নিতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ্।
এটি ছিল চ্যালেঞ্জিং , প্রায় ২০০০ কি,মি,। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় হয়েছিল নব সংযোগ। প্লেনে সময় লাগে প্রায় ৩ঃ৩০ মিনিট, তবে রিবনিক পর্যন্ত নয়, কাতওিচে পর্যন্ত।
আমি শিখেছি ধৈর্য এবং নমনীয় হতে, প্রবৃত্তিকে বিশ্বাস করতে, শিখেছি পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে, এবং আর উপভোগ করেছি প্রতিটি মুহূর্ত করি, যা সবসময় সহজ নয় আর সম্ভবও নয়।
২০০৯ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে গিয়েছিলাম এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিনে, এস্তোনিয়ান গার্মেন্টস ইম্পোরটিং কোম্পানি সুভা এর ডিরেক্টর অ্যালেক্স এর সাথে এক ব্যবসায়িক মিটিঙে।
তাল্লিন থেকে পরবর্তী মিটিং ছিল এই পোল্যান্ডেরই “সবুজ” শহর খ্যাত রিবনিকে, আমার পোলিশ ( গার্মেন্টস ব্র্যান্ডের ) হোস্ট কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্টের সাথে। আগে থেকে কমিউনিকেশন চলছিল হোস্ট কোম্পানির পারচেজ ডিপার্টমেন্টের বারবারা কুবিয়েনিয়েকের সাথে, যে খুব ভাল ইংরেজী জানে।
ফ্রাঙ্কফুর্ট আর তাল্লিনে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সফরে হয়ে পরেছিলাম পুরোপুরি ক্লান্ত আর পরিশ্রান্ত ( মানসিক ভাবে! শারীরিকভাবে নয় কিন্তু হুউউউ )। তারপরও যেতে হবে পোল্যান্ডের রিবনিকে, ফর ব্রেড অ্যান্ড বাটার।
ব্যবসায়িক সফরে্র কারনেই করতে হচ্ছিল বিমান ভ্রমণ, কর্পোরেট লেভেলের থাকা খাওয়া, চলা ফেরা।
আর তাই মনে মনে ভাবলাম কেমন হয় আকাশ পথে ভ্রমণ না করে, সড়ক পথে ভ্রমণ করলে ? এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিন থেকে পোল্যান্ডের রিবনিক পর্যন্ত হিচ হাইকিং করলে ! ব্যাকপ্যাকিং ! !
যেই ভাবা সেই কাজ। এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিনের সকল ব্যবসায়িক কাজ শেষ করেই সাথে, আমার প্রিয় গ্যাজেট এসার ল্যাপটপ, এইসটিসির ডূপডের পিডিএ আর সনি ডিজিটাল ক্যামেরা সহ কিছু হালকা কাপড়ের সাথে শুধুমাত্র এক সেট ফর্মাল ড্রেস সাথে নিয়ে) আর কিছু প্রয়োজনীয় ফাইল সাথে নিয়ে বের হয়ে পড়লাম তাল্লিনের বাস স্টেশনের দিকে।
ইচ্ছে আছে সময় ও সুযোগ পেলে এস্তোনিয়ার ভ্রমণ সম্পর্কে ও লিখার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ্।
তাল্লিন থেকে রিগা তে আপনি বিভিন্ন ভাবে যেতে পারেন, বিমানে, বাসে, ট্রেনে এমনকি ক্রুজেও।
সময়টা ছিল জুলাই মাস। গ্রীষ্মকাল। আমি গিয়েছিলাম বাসে। তাল্লিন্ন বাস ষ্টেশন থেকে রিগা পর্যন্ত। খুজতে লাগলাম সবচেয়ে সস্তায় কিভাবে রিগা পর্যন্ত যাওয়া যায়, অনেক খুজে পেলাম তাল্লিন্ন বাস ষ্টেশনে লাক্স এক্সপ্রেস এর ডাবল ডেকার বাসগুলো। আমার কাছে সস্তায় ভাল লেগেছিল লাক্স এক্সপ্রেস এর বাসগুলোই। কিন্তু আমাদের দেশের মত সস্তার তিন অবস্থা নয়।
লাক্স এক্সপ্রেস কোচ আরো সুবিধাসমুহঃ
১। ইন্ডিভিজুয়াল টাচ স্ক্রীন মিডিয়া ডিভাইস (চলচ্চিত্র, গেমস, সঙ্গীত, ইন্টারনেট)।
২। গরম পানীর ব্যবস্থা।
৩। বিনামূল্যে পানির বোতল।
৪। এয়ার কন্ডিশনার
৫। সীট বেল্ট সহ প্রতিটি সীট
৬। যারা ভাবেন ইউরোপ মানেই মদ আর মদ, তাদের জন্য দুঃসংবাদ, এই বাসে ধুমপান আর অ্যালকোহল পান করার অনুমতি নেই
তাল্লিন্ন বাস ষ্টেশনে লাক্স এক্সপ্রেসে
– পেয়েছি আরামদায়ক প্রশস্ত বসার সিট
– লেড টিভি
– বাসের ভিতর হাই স্পীডের ফ্রী ওয়াইফাই, নো সাফারিং, নো বাফারিং।
তাল্লিন থেকে রিগা তে ৪ ঘন্টা ২৫ মিনিটের পথ। লাক্স এক্সপ্রেস লাউঞ্জ এ না গিয়ে আপনি যদি লাক্স এক্সপ্রেসে যান, তবে ৫ ইউরোতে ও যেতে পারবেন, যদি সিট খালি পান।
তাল্লিন্ন বাস ষ্টেশনে লাক্স এক্সপ্রেসে ল্যাপ্টপ চার্জের জন্য সিটের পাশে মাল্টি প্লাগ (২২০ ভি )
– বাসের ভিতর পরিষ্কার ওয়াশ রুম (শৌচাগার)
– পেয়েছি দুর্দান্ত স্পীড, কিন্তু সিটে বসে কফি খেলেও আপনার কাপড়ে পরবে না। বুঝতে পেরেছেন !!! কি রকম দক্ষ ড্রাইভার আর কি রকম রাস্তা !
– আর ফ্রীতে পেয়েছি অসাধারন মনমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য
আমি আগে থেকে টিকেট কেটে রাখিনি, বাস ষ্টেশনে গিয়েই কেটেছিলাম, আর তাই ভাড়াও লেগেছিল একটু বেশি, ২০ ইউরো। কিন্তু আপনি যদি আগে থেকে ( ৩ দিন বা ৭ দিন বা ২০ দিন), কাউন্টারে বা অনলাইনে টিকেট কিনেন, তবে ৮ ইউরো থেকে ১২ ইউরোর মাঝেও পেয়ে যাবেন।
আপনি যদি হিসেব করেন ২০ ইউরো মানে ১৬০০ টাকা???? এতো অনেক টাকা। কিন্তু না অনেক টাকা নয়। বাল্টিক দেশগুলোতে যারা সবচেয়ে নিম্ন আয়ের কাজ করে্ন, তারাও পায় ঘণ্টায় ২ থেকে ৫ ইউরো, যারা স্কেন্ডিনেভিয়ান আর বেনেলুক্স দেশগুলোতে সবচেয়ে নিম্ন আয়ের কাজ করেন, তারা পায় ঘণ্টায় ১০ থেকে ২০ ইউরো আর যারা সাউথ ও ইষ্ট ইউরোপের দেশগুলোতে সবচেয়ে নিম্ন আয়ের কাজ করে, তারা পায় ঘণ্টায় ৬ থেকে ১৫ ইউরো। তবেই বুঝুন ! ! ! সবচেয়ে নিম্ন আয়ের কাজ করে ২ বা ৪ ঘণ্টার আয়ের টাকা দিয়ে আপনি বাসে করে সস্তায় কিন্তু সবেচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে এক দেশ থেকে আরেন দেশ ভ্রমণে যাচ্ছেন !!!!!
পারব কি আমি আমার দেশে বা সার্কের কোন দেশে ? সবচেয়ে নিম্ন আয়ের কাজ করে ২ বা ৪ ঘণ্টার আয়ের টাকা দিয়ে বাসে করে সস্তায় কিন্তু সবেচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়ে এক দেশ থেকে আরেন দেশ ভ্রমণ করতে !!!!!
অথচ একজন খেটে খাওয়া মানুষ হিসেবে, আমাকে আমার দেশেও ট্যাক্স দিতে হয়, আর স্পেনেও আমাকে ট্যাক্স দিতে হয়। কিন্তু নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির পার্থক্য একটু বিশালই বটে।
মহান আল্লাহতায়ালার কাছে এটাই প্রার্থনা করি, ইনশাআল্লাহ্ একদিন আমার দেশ বাংলাদেশেও আমরা, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত আর নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষেরা সর্বনিম্ন ব্যয় করে সবেচেয়ে বেশি নাগরিক সুবিধা পাব।
ছিলাম বাসের দোতলাতে, একদম সামনে, ড্রাইভারের ঠিক মাথার উপরে, ঘুমিয়ে পরেছিলাম রিগার কাছা কাছি আসার আগেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। সামনে তাকিয়ে দেখি যেন বসে আছি ৫০০” লেড টিভির সামনে। কি অসাধারণ দৃশ্য সূর্য মামা অস্ত যাচ্ছে ! লাল টকটকে নীল আকাশের মাঝে আর নিচে ধূসর সবুজ ! ! ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা সেই মনমুগ্ধকর দৃশ্যটি ! ! !
ভাবলাম সন্ধ্যা হয়েছে সূর্য তো অস্ত যাবেই। আচমকা সাথে থাকা পিডিএ ( এইচটিসি এর ডুপড) এর দিকে চোখ যেতেই ছানাবড়া ! ! !
– রাত ১১ টা বাজে ! সূর্য মামা অস্ত যাচ্ছে ! ! !
– ছোটবেলাতে তো পরেছিলাম উত্তর গোলার্ধ।
– ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি তো এখন উত্তর গোলার্ধের কাছেই, হাহাহাহা নর্থ পোল থেকে মাত্র ১৬০০ কি,মি, দূরে ! ! ! কার ড্রাইভে মাত্র ১৮ ঘন্টা ! ! !
– আর তাইতো সূর্য অস্ত যাচ্ছে রাত ১১ টায় আর সূর্য উঠতে দেখেছি মধ্য রাতে ! রাত ৩ টায়।
তাল্লিনের বাস স্টেশন থেকে চলে এসেছিলাম লাটভিয়ার রাজধানী রিগায়।

আপনদের সময় , সুযোগ আর ইচ্ছে হলে,আমার লাটভিয়া ভ্রমণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পরতে পারেন:
অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, আমার লেখাতে ভুল্ভ্রান্তি গুলোর কারণে, আমি তো আর প্রফেশনাল লেখক নই, এরপর আবার সাহিত্যের শব্দ চয়নে অনেক দুর্বল।

দীর্ঘ পথের এস্তোনিয়ার রাজধানী তাল্লিনের থেকে লিথুয়ানিয়ার কাউনাস হয়ে, পোল্যান্ডের ওয়ারস আর লজ হয়ে পৌঁছেছি কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই এই রিবনিক এর কাছাকাছি ৬০ কি।মি। দূরে কাতোউচে তে হিচ হাইকিং করেই।
লিথুয়ানিয়ার ভ্রমণ সম্পর্কেও লিখার ইচ্ছা আছে ইনশাআল্লাহ্। চলবে–
Shibly Sadiq , Entrepreneur , Blogger , Activist, Mentor
shiblysadiq@hotmail.com