আমীর জাহিদ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১, ঢাকা থেকে জীপগাড়ীতে চড়ে নেত্রকোণা শহর হয়ে নেত্রকোণার ধর্মপাশা উপজেলার মধ্যনগর ইউনিয়নের ঘাট থেকে জলযানে চড়েছি। সিলেট বেসিনের হাওরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। দু’ধারে দিগন্তবিস্তৃত নীল জল। মাঝে মাঝে জলজ গাছগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কখনো হাঁসের দল, কখনো জলে ভাসা পদ্ম, কখনো মাথার উপর উড়ন্ত পাখী, পানির উপরে দ্রুত ধাবমান নৌকা, বজরা, বা স্পীডবোট পাশ কেটে যাচ্ছি। উদ্দেশ্য হিজল করচের বন। সেখানে একটু জিরিয়ে তারপর যাব নিলাদ্রি। অন্ধকার নামার আগে ফিরতে হবে, নতুবা সাগরের মত হাওরে দিক হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা, কিংবা নলখাগড়ার বনে আটকে ঘন্টা পেরিয়ে যাওয়ার। এত সুন্দর প্রকৃতি হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হতো না। ওয়াচ-টাওয়ার ঘিরে হিজল করচের বনে আনন্দের হাট!

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। সিলেটের সুনামগঞ্জে মোট ফসলি হাওরের সংখ্যা ছোট-বড় মিলিয়ে ১৩৩টি। তার মধ্যে টাঙ্গুয়ার হাওরই সব চাইতে বড়। এ হাওর উপজেলার প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। ১৯৯১ সালে গৃহীত রামসার কনভেনশন অনুযায়ী টাংগুয়ার হাওরকে ওয়ার্লড হেরিটেজ রামসার সাইট ঘোষনা করা হয়। মেঘালয় পাহাড় থেকে ৩০টিরও বেশি ঝরনা এসে মিশেছে এই হাওরে। দুই উপজেলার ১৮টি মৌজায় ৫১টি হাওরের সমন্বয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর জেলার সবচেয়ে বড় জলাভূমি। গভীর পানির মূল হাওর ২৮ বর্গকিলোমিটার এবং বাকি অংশ অগভীর হাওর যা শুকনো মৌসুমে বোরো ধানের জমিতে পরিণত হয়, হাওরের পাড় ও গ্রামগঞ্জ। বেশ কিছু টিনের তৈরি ঘরবাড়ি নজরে পড়েছে। বর্ষার সময় গভীর হাওর, কৃষিজমি, বাড়িঘর পানিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে সমুদ্রের আকার ধারণ করে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের জীববৈচিত্র্যের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন জাতের পাখি। স্থানীয় বাংলাদেশী জাতের পাখি ছাড়াও শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে পরিযায়ী পাখিরা আসে। প্রায় ৫১ প্রজাতির পাখি বিচরণ করে। স্থানীয় জাতের মধ্যে শকুন, পানকৌড়ি, গাঙচিল, বক, সারস, বেগুনি কালেম, ডাহুক, বালিহাঁস, কাক, শঙ্খচিল, পাতিকুট ইত্যাদি পাখির নিয়মিত বিচরণ। টাঙ্গুয়ার হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ হাওরের বিখ্যাত মাছ মহাশোল। হাওরের উদ্ভিদের মধ্যে অন্যতম করচ, হিজল, বরুণ, পানিফল, হেলেঞ্চা, বনতুলশী, নলখাগড়া, বল্লুয়া, চাল্লিয়া ইত্যাদি জাতের উদ্ভিদ। ভ্রমণপিয়াসুরা হাওরের লম্বা পানি পথ পাড়ি দিয়ে করচ হিজলের ওয়াচ টাওয়ার বনে একটু থেমে নীলাদ্রিতে যায়। ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চারিদিকের দৃশ্য খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করা যায়।

আমরা করচ-হিজলের বনে নৌকা বেঁধে, শহর থেকে রেঁধে নিয়ে আসা দুপুরের খাবার খেয়েছি। লম্বা সফরের মধ্যে নৌকার ফেরিওয়ালা থেকে লাল চা পান ছিল বিশেষ স্বস্তিদায়ক। এর পর পুনরায় যাত্রা শুরু করি। হাওরের জল কেটে যতই ভূমির দিকে এগুচ্ছি ততই উত্তেজনা বোধ করছি। সিনেমার দৃশ্যের মতো একটার পর একটা মনোরম দৃশ্য আমাদের মানসপটে চিত্র এঁকে যাচ্ছে। একসময় বোট তাহিরপুরের ভূমির লাগোয়া জলে নোঙর করলো। সদলবলে বোট থেকে নেমে সমতলে গিয়ে দাঁড়ালাম। একদিকে পাহাড় আরেকদিকে জল এবং মধ্যখানে সমতল, প্রকৃতির এই তিন রূপে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। দেশের উত্তরাঞ্চলীয় পাদদেশীয় ভূমি (Northern & Eastern Piedmont Plains এর অন্তর্ভুক্ত Northern অঞ্চল)এর এই অংশটি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের এক চিলতে ভূমি, এর সীমানা বরাবর ভারতের মেঘালয়।

গত বছর এমনি সময়ে নেত্রকোণার দুর্গাপুর হয়ে এই টিলা সমৃদ্ধ এলাকায় পৌঁছার অভিযানে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে সে অভিযান সফল হয়নি। এবার যাওয়াটাই ছিল অনিশ্চিত, বিশেষ করে পরিবারের সম্মতি পাওয়া। শেষ পর্যন্ত নেত্রকোণা-সুনামগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চল পাড়ি দিয়ে তাহিরপুরে যখন পঁউছি তখন তার অপার সৌন্দর্য অবলোকন করার জন্য আমাদের হাতে মাত্র এক ঘন্টার সূর্যালোক অবশিষ্ট আছে। নেত্রকোণার দুর্গাপুর থেকে তাহিরপুর হয়ে সিলেটের উত্তর পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত একফালি ভূমি পাহাড়ি সমতল ও টিলাসমৃদ্ধ ভূমি। বর্ষাকালে এই পুরো এলাকা পাহাড়ী ঢলে (flash flood) আক্রান্ত হয়। নিলাদ্রি লেকের পানি, চারিদিকের মনোরম প্রকৃতি ও প্রতিবেশ সত্যি মনোহরণকারী। লেকের পাশ দিয়ে হাওরের বুক চিরে বয়ে চলে যাচ্ছে পাথর ভর্তি নৌকা।
এখানে পাহাড় কেটে কেটে পাথর উঠানো হয়। মাঝের টিলাগুলো আর ওপারের পাহাড়ের নিচের অংশটুকু বাংলাদেশের। নীলাদ্রি লেকটি এক সময় চুনাপাথরের কারখানার কাচামাল সরবরাহের ভান্ডার ছিল যা এখন বিলীন হয়ে গেছে। ছোট ছোট টিলাগুলি দেখতে কি চমৎকারই না লাগছিল। কিন্তু সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, রাজাই মৌজায় বারিক টিলার টুরিস্ট স্পটে যেতে হবে মোটর সাইকেলে করে। অপরিমেয় সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের আরেক দর্শনীয় স্থান হল বারিক টিলা [a hillock beside Jadukata river with 150 feet of height], স্থানীয়ভাবে যাকে বারিক্কার টিলা বলে। একে বাংলার আইফেল টাওয়ার নামেও অভিহিত করা হয়। এ টিলার নীচ দিয়েই বয়ে গেছে রূপসী নদী যাদুকাটা। স্বচ্ছ সলিলা যাদুকাটা নদী ভারতের খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড় থেকে উৎপত্তি লাভ করে এস্থান দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

এই নদীকে কেন্দ্র করে তাহিরপুর ও পার্শ্ববর্তী বিশ্বম্বরপুর উপজেলার প্রায় ২০-২৫ হাজার শ্রমিক পাথর, বালু, নুড়িপাথর আহরণ করে কর্মসংস্থান করছে। আহরিত বালু, পাথর ও নুড়িপাথর দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রয়োজনীয় উপকরণ জোগায়। বর্ষায় পাহাড়ি নদী যাদুকাটার বুকে জলের স্রোতধারা বয় আর হেমন্তে শুকিয়ে যাওয়ায় দেখা যায় ধু-ধু বালুচর। টিলার উপর থেকে শান্ত নদীর স্বচ্ছ নীলাভ পানি, পানির নীচে চিকচিকে সাদা নুড়িপাথর আর ধু-ধু বালুর পাড়ের দৃশ্যাবলী যে কারোরই মন কাড়বে। নীলাদ্রি লেক থেকে বারিক টিলা পর্যন্ত সরু পথের দু’ধারে পাহাড়তলির সমতল, ছোট ছোট টিলা, পাহাড় থেকে নেমে আসা সমতলের বুক চিরে মাঝে মাঝে ঝর্ণার প্রবাহ, ধানের ক্ষেত, পাহাড় ক্ষয়ে বা ধ্বসে সমতলে আসা নুড়িপাথর দেখতে দেখতে কখন যে সময় ফুরিয়ে যাবে ঠাওর করা যাবে না।
অতি প্রাচীনকালে সিলেটসহ বাংলার এক বিশাল ভূখণ্ড কামরূপ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং এর রাজধানীর নাম ছিল প্রাগজ্যোতিষপুর। কামরূপ রাজ্যের শাসক ছিলেন রাজা ভগদত্ত। সুনামগঞ্জের লাউড় পরগণায় রাজা ভগদত্তের উপরাজধানী ছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিজয় মাণিক্য নামে জনৈক হিন্দু রাজা লাউড় রাজ্যে রাজত্ব করেন। শ্রীহট্রের ইতিবৃত্তে বর্ণিত যে, উক্ত লাউড় রাজ্য সকল সময় স্বাধীন ছিল। ঐতিহাসিক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের মতে, সম্ভবত ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে লাউড় রাজ্য স্বাধীনতা হারায় এবং মোগলরা এর নিয়ন্ত্রক হন।

বারিক টিলা থেকে ঘাটে ফিরতে আমাদের ফিরতে সন্ধ্যে নেমে গিয়েছিল। যা করা একেবারেই অনুচিত। মাঝি ঝটপট বোট স্টার্ট দিয়ে হাওরের মাঝে নদীতে গিয়ে পড়ল। অন্ধকার, পানির উপরে ভাসমান বোটে আমরা কয়েকটি নিরীহ প্রাণী! আকাশে লক্ষকোটি তারা। সাদা হয়ে আছে। গতবার যখন ধনু নদীর উপর দিয়ে যাই তখনও এমন অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল। এখন কাওলাই-গুনাই নদী পথে আসতে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন! সৃষ্টিকর্তা যে চোখ দিয়েছেন তা যেন ধন্য হলো! সেবারও ক্যামেরায় ব্যাটারির আয়ু ফুরিয়ে গিয়েছিল, এবারও তাই। সিনিয়র অফিসারের কথায় সম্ভিত ফিরে পেলাম। তিনি বললেন, “জাহিদ, দেখো ছায়াপথ দেখা যাচ্ছে।” আমি ভালো করে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কী অদ্ভুত সুুন্দর দৃশ্য! আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত বিশাল ঝালরের ন্যায় ছায়াপথ খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি। ইংরেজি যাকে বলে মিল্কিওয়ে।

স্পীডবোট একটানা শব্দ করে পানি কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে বিপত্তি ঘটলো। দেরি করে ফেরার খেসারত হিসাবে মাঝি পথ চিনতে না পেরে এক ঘন্টার মতো আমাদের নিয়ে গোলোকধাঁধায় ঘুরেছে। তারপর একবার নলখাগরার বনে আটকে থেকেছে। সজ্জন আরেক নৌকার মাঝির সাহায্যে এ যাত্রায় উদ্ধার পেয়েছি। অন্ধকার আকাশে তখন বিজলী চমকাচ্ছিল। হাওরে নাকি বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু হয়।! জলের কয়েক ফোঁটা গায়ে এসে পড়লো। এভাবে শঙ্কার মধ্য দিয়ে বাকী পথটুকু অতিক্রম করে মধ্যনগর ঘাটে পৌঁছলাম। এক রাশ ভালো লাগা অনুভূতি নিয়ে নেত্রকোণা যখন ফিরেছি তখন রাত ১০টা প্রায়।