মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা মিথ্যাবাদী থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়ঃ—–
মিথ্যা ই সকল পাপের উৎস এবং সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত বায়বীয় পদার্থ ।
মিথ্যাকে সব পাপের জননী বলা হয়। একটি মিথ্যা থেকে শতশত পাপের সূত্রপাত হয়। ছোটো খাটো মিথ্যা বলতে বলতে মানুষ ধীরে ধীরে মিথ্যা বলায় অভ্যস্ত হয়ে যায় । তখন মিথ্যা কথা বলতে আর দ্বিধাবোধ করে না। যে কোনো বিষয়ে মুখ দিয়ে অকপটে মিথ্যা বের হয়ে আসে।মিথ্যাবাদীকে বন্ধু বানালে তার জন্য আপনি নিজেও সমাজের কাছে মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেন।প্রিয় কেউ মিথ্যুক হ’লে তাকে বাঁচাতে আপনাকে মিথ্যা বলতেই হবে।
সম্প্রতি বিবিসি একটি জরিপ করে দেখেছে যে, পুলিশ, আইনজীবি এবং বিচারকেরা কয়েদীদের চেয়ে ও বেশী মিথ্যা বলেন।
একটু খেয়াল করে দেখবেন আপনার কন্যা এবং পুত্র সন্তানের মধ্যে কে বেশী মিথ্যা বলে। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি পরিবারের ছোট সন্তান সবচেয়ে বেশী মিথ্যা বলেন। তার কারণ হচ্ছে সে বড় ভাইবোনদের থেকে শাসনের শিকার হয়ে থাকে।
মিথ্যাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই কেবল ঘৃণা করা হয় না বরং সব বর্ণের-ধর্মের মানুষ মিথ্যাকে ঘৃণা করে।আবার অনেক কিছু মিথ্যার উপরে ই প্রতিষ্ঠিত । যারা কোনো ধর্ম মানে না, তারাও মিথ্যাকে ঘৃণা করে। যারা অনর্গল মিথ্যা বলে, তারাও মিথ্যাকে ঘৃণা করে। মিথ্যাবাদীও চায়, অন্যেরা তার সঙ্গে সত্য কথা বলুক।মিথ্যুকের লজ্জা শরম বলতে কিছুই থাকে না।
আমরা দিনে দিনে মিথ্যার সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছি। আমাদের অবস্থা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, আমরা কখন যে মিথ্যা কথা বলছি, সেটা নিজেরাই বুঝতে পারি না। কথায় কথায় খুব সাধারণ বিষয়ে অবলীলায় মিথ্যা কথা বলে ফেলি,আরেকজনকে মিথ্যুক বানিয়ে ফেলি। অতি সাধারণ বিষয়েও মিথ্যা বলা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে।জাতীয় মানুষেরা জাতীয় গণমাধ্যমের আলোচনায় বসে মিথ্যা ব’লে যাচ্ছেন অবলীলায়।
আমরা ছোটদের যতই শিক্ষা দিয়ে থাকি, মিথ্যা বলা মহাপাপ কিন্তু নিজেরাই যদি মিথ্যা বলা থেকে বের না হয়ে আসতে পারি, তাহলে তারাও আমাদের থেকে মিথ্যা কথা বলা শিখে যায়।পিতামাতারাও সন্তানের সামনে বসে নির্দিধায় মিথ্যা বলছেন।সমাজের নামকরা লোকেরা মিথ্যার উপরেই প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। আবার তাঁরাই এক্কেবারে ধর্মীয় লেবাসধারী।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে মিথ্যা বলাটা সহজ হয়ে গেছে। ঘরে অশান্তির সীমা নাই কিন্তু শুধুই শান্তির ছবি পোস্ট করেই যাচ্ছেন একদল ফেইসবুকি আদমসন্তান। বিশেষ করে মোবাইল কল বা মেসেজে। ঘরে অবস্থান করে বলে বাইরে। বাইরে কোথাও ঘুরতে গিয়ে বলা হয় অফিসে বা কর্মস্থলে। ধর্ম-কর্মে মিথ্যার মাধ্যমে ধোঁকাবাজি প্রতিনিয়ত চলছেই। মিথ্যা এতটাই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে যে, এটা কিছু লোকের অবিচ্ছেদ্য স্বভাবে পরিণত হয়েছে। আমরা মিথ্যার এত কাছাকাছি বাস করছি, এটা পাপ বা সর্বজনস্বীকৃত ঘৃণ্য কাজ হওয়া সত্ত্বেও তার প্রতি একটুও বিরক্তি সৃষ্টি হচ্ছে না। মিথ্যা একাল-ওকাল দুটোই ধ্বংস করে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশী মিথ্যা বলেন রাজনৈতিক নেতারা এবং ব্যাবসায়ীরা। ব্যাবসায়ীদর মধ্যে সবচেয়ে মিথ্যুক হচ্ছেন ভ্যান গাড়ি, ফুটপাতের দোকানদারেরা আর কাচামালের ব্যাবসায়ীরা।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার চকবাজারের ব্যাবসায়ীদের কেউ বিশ্বাস করে না। আজকাল ফেইসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে যারা ব্যাবসা করছেন তারাও তাদের বিশ্বস্ততা হারিয়ে ফেলেছেন বেশীরভাগ ক্ষেত্রে।
অথচ মিথ্যা বলা ছেড়ে দিলে প্রায় সব সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়। বাঁচা যায় পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে। মিথ্যা বলার চেয়ে নিকৃষ্ট গুনা আর নেই।
মিথ্যা বলার সর্বপ্রথম চর্চা শুরু হয় প্রেম করা থেকে। আসলে প্রেম ই হচ্ছে একটা ধোঁকাবাজি। সারাদিন বয়গার্ল বন্ধুর দুরভিসন্ধি থেকে মিথ্যা শুরু হয়ে সংসার জীবন পর্যন্ত গড়ায়।
মিথ্যার খেসারত দেয় না এমন কেউ নাই। মিথ্যাবাদীকে আল্লাহ প্রচণ্ড ঘৃণা করেন। আল কোরআন ও হাদিসে মিথ্যুক এবং মিথ্যাবাদীর ভয়ানক পরিণতির কথা বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার অনুসরণ কর না।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ৩৬)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে, তখন মিথ্যার দুর্গন্ধে ফেরেশতারা মিথ্যাবাদী থেকে এক মাইল দূরে চলে যায়।’ (তিরমিজি : ১৯৭২)
হিংসাপরায়ণ হয়ে মিথ্যা বলা, মন্দ ধারণা থেকে মিথ্যা বলা, বিদ্বেষী মনোভাব থেকে মিথ্যা বলা, বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে মিথ্যা বলছি অহরহ। আল্লাহতায়ালা মিথ্যাবাদীকে ঘৃণা করেন এবং এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। আল্লাহ আল কোরআনে হুশিয়ার করে বলেন, ‘সুতরাং পরিণামে তিনি তাদের অন্তরে নিফাক (দ্বিমুখিতা) রেখে দিলেন সেদিন পর্যন্ত, যেদিন তারা তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, তারা আল্লাহকে যে ওয়াদা দিয়েছে তা ভঙ্গ করার কারণে এবং তারা যে মিথ্যা বলেছিল তার কারণে। (সূরা তওবা, আয়াত : ৭৭)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসূল (সা.) বলেন, ‘সত্যবাদিতা হচ্ছে শুভ কাজ। আর শুভ কাজ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর বান্দা যখন সত্য বলতে থাকে, এক সময় আল্লাহর কাছে সে সত্যবাদী হিসেবে পরিচিত হয়। আর মিথ্যা হচ্ছে পাপাচার, পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়, বান্দা যখন মিথ্যা বলতে থাকে, আল্লাহর কাছে এক সময় সে মিথ্যুক হিসেবে গণ্য হয়’। (বুখারি : ৫৭৪৩, মুসলিম : ২৬০৭)।
আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ বাক্য আছে। ‘চিলে কান নিল’ বলে অযথা চিলের পেছনে দৌড়ানো। অথচ হাত দিয়ে একবারও কানটা ধরে দেখনি আসলেই কান নিয়েছে কিনা। এটাকে বলে ‘কানকথা’ বা ‘শোনা কথা’। কোনো কথা শুনেই এখানে-সেখানে বলে বেড়ানো হাদিসের ভাষায় এটাকেও মিথ্যা বলা হয়েছে। রাসূল (সা.) বলেন, ‘কারও কাছে কোনো কথা শোনামাত্রই তা বলে বেড়ানো মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুসলিম : ৯৯৬)।
মিথ্যাবাদী হওয়া মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ মিথ্যাবাদীর শাস্তির কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘তাদের হৃদয়ে আছে একটি রোগ, আল্লাহ সে রোগ আরও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন, আর যে মিথ্যা তারা বলে তার বিনিময়ে তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’। ওদের যখন বলা হয়, তোমরা পৃথিবীতে অনাচার কর না, তারা বলে, আমরা তো শান্তি স্থাপনকারী। জেনে রাখ, ওরাই অনাচার বিস্তারকারী, কিন্তু ওদের চেতনা নেই’। (সূরা বাকারা, আয়াত : ১০-১২)।
যারা মিথ্যাবাদী, তারা এতে সাময়িক সুবিধা পেলেও ইহকালে এরা নিন্দিত হবে এবং পরকালে পাবে কঠিন শাস্তি। যারা সত্যবাদী, তাদের জীবনের পথচলা একটু কঠিন হলেও তারা ইহকালে হবে সম্মানিত এবং পরকালে পাবে উপযুক্ত পুরস্কার।
গতকাল সারাদিন মিথ্যা বলেও আজ মিথ্যা পরিত্যাগ ক’রে তওবা করলেও আল্লাহ পাক ক্ষমা করে দিবেন ইনশাআল্লাহ।