মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: দুনিয়া সৃষ্টির পর থেকে সকল নবীর উম্মতকেই কুরবানী করতে হয়েছে। আল্লাহতায়ালার এ বিধান মানব জাতির সৃষ্টি লগ্ন থেকেই কার্যকর হয়ে আসছে। মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোননাকোনভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে আসছে । এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত। এ ফিতরাতের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তা’য়ালা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন —
وَلِـكُلِّ اُمَّةٍ جَعَـلْـنَا مَنْسَكًا لِّـيَـذْكُرُوْا اسْمَ اللهِ عَلى مَـا رَزَقَـهُمْ مِنْ بَـهِيـْمَةِ الْاَنْـعَـامِ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন”। (সূরা আল হজ্জ-৩৪)
মানব ইতিহাসের সর্বপ্রথম কুরবানী হযরত আদম আ. এর দুই পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদ সহ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে কাসীর একে ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমীন ও ওলামায়ে মোতায়াখ্খেরীনের সর্ব সম্মত উক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন। ঘটনাটি এই : যখন আদম ও হাওয়া আ. পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্ম গ্রহণ করত। তখন এক শ্রেণীর ভাই বোন ছাড়া হযরত আদমের আর কোন সন্তান ছিলনা। অথচ ভাই বোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তাই মহান আল্লাহ উপস্থিত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আদম আ. এর শরীয়তে বিশেষ ভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্ম গ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন গণ্য হবে। সুতরাং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে কন্যা সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোনটি ছিল খুবই সুশ্রী-সুন্দরী তার নাম ছিল ‘আকলিমা’ আর হাবিলের সহজাত বোনটি ছিল তুলনামূলক কম সুন্দরী তার নাম ছিল ‘গাজা’। বিবাহের সময়ে হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত অসুন্দরী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে গেল। সে জেদ ধরল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হযরত আদম আ. তাঁর শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন। অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী গৃহিত হবে, সে-ই উক্ত কন্যার পানি গ্রহণ করবে। হযরত আদম আ. এর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, যে সত্য পথে আছে, তার কুরবানীই গৃহিত হবে। তৎকালে কুরবানী গৃহিত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নি শিখা এসে কুরবানীকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন ঃ بِـقُـرْبَـانٍ تَـأكُـلُـهُ الـنَّـارُ “ঐ কুরবানী যাকে আগুন গ্রাস করে নিবে”। (সূরা আলে ইমরান-১৮৩) আর যে কুরবানীকে অগ্নি ভস্মীভূত করত না, সেটাকে প্রত্যাখ্যাত গণ্য করা হত। কুরবানীর এ তরীকা খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ সা. এর যুগ পর্যন্ত সকল পূর্বেকার নবীর যুগে বলবৎ ছিল। হাবিল ভেড়া, দুম্মা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। কাবিল কৃষি কাজ করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্যে পেশ করল। (তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূত্র হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত) অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নি শিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানীটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না। তাই সে হাবিলকে হত্যা করার সংকল্প করল এবং এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করে ফেলল।
মাআ’রেফুল কুরআন বাংলা সংস্করণ-৩২৪ পৃষ্ঠা) হাবিল ও কাবিলের কুরবানীর ঘটনা পবিত্র কুরআনে এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে:
وَاتْلُ عَلَيْـهِمْ نَبَاَ ابْـنَـىْ ادَمَ بِـالْـحَـقِّ- اِذْ قَـرَّبَـا قُـرْبَانًا فَـتُـقُـبِّـلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَلَمْ يُـتَـقَبَّلْ مِنَ الْاخَرِ- قَالَ لَاَقْتُلَـنَّكَ- قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ- لَئِنْ بَسَطْتَّ اِلَىَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِىْ مَا اَنَا بِبَاسِطٍ يَّدِىَ اِلَيْكَ لِاَ قْتُلَكَ- اِنِّىْ اَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعلَمِيْنَ- اِنِّىْ اُرِيْدُ اَنْ تَبُـوْاَ بِـاِثْمِىْ وَاِثْمِكَ فَتَكُـوْنَ مِن اَصْحبِ النَـارِ- وَذلِكَ جَزؤُ الظّلِمِيْنَ- فَطَوَّعَتْ لَـهُ نَـفْسُه قَـتْلَ اَخِـيْـهِ فَقَـتَـلَهُ فَاَصْبَحَ مِنَ الْـخسِرِيْنَ- فَبَـعَـثَ اللهُ غُـرَابًا يَبْحَثُ فِى الْاَرْضِ لِيُرِيَهُ كَـيْـفَ يُـوَارِىْ سَـوْءَةَ اَخِيْهِ- قَالَ يـوَ يْلَتـى اَعَجَزْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِـثْلَ هـذَا الْغُرَابِ فَاُوَارِىَ سَـوْءَةً– فَاَصْبَحَ مِنَ النّدِمِيْنَ
“আপনি তাদেরকে আদমের দু’পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। (তা হচ্ছে এই যে,) যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহিত হল আর অপর জনের কুরবানী গৃহিত হলোনা। তখন সে ভাইকে বলল- অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল আল্লাহ তো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন। যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্ব জগতের পালন কর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অত:পর তুমি জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতি গ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সে কিভাবে সমাহিত করবে। সে বললো, আফসোস! আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সমাহিত করি! অত:পর সে অনুতাপ করতে লাগল”।(সূরা আল মায়িদাহ, ২৭-৩১ আয়াত)। উল্লেখ্য যে, হযরত আদম আ. এর পর সকল উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছন্ন ভাবে কুরবানীর ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
অত;পর আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফল ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন। আশা করি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে”। (সূরা আল ইবরাহীম -৩৭)
উপরোল্লিখিত পরক্ষিাগুলির কঠিন মঞ্জিল অতিক্রম করার পর হযরত ইবরাহীম আ. কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। যা বিগত পরীক্ষাগুলির চেয়ে ও অধিক কঠিন, হৃদয় বিদারক ও আল্লাহ প্রেমের কঠিন পরীক্ষা। কোন কোন বর্ণনা মতে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন তিনি পরপর তিন রাত্রি দেখেন। স্বপ্নে তিনি একমাত্র প্রিয় পুত্র ইসমাঈল কে কুরবানী করতে আদিষ্ট হন। প্রাণ প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ তাঁকে এমন সময় দেয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন পালন করার পর পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারে এবং তাঁকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে। তাফসীরবিদগণ লিখেছেন: এ সময় হযরত ইসমাঈলের বয়স ছিল তের বছর। কেউ কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন (তাফরীরে মাযহারী)। তবে তাফসীরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা। এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহীর অর্ন্তভূক্ত। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রতি একমাত্র পুত্রকে যবেহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেয়ার কারণ হলো হযরত ইবরাহীম আ. এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। হযরত ইবরাহীম আ. মহান প্রতি পালকের নির্দেশ পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহীম আ. এর ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাই তিনি তার পুত্র ইসমাঈলকে লক্ষ্য করে বললেন : قَالَ يبُنَىَّ اِنِّىْ اَرى فِى الْمَنَـامِ اَنِّى اَذْ بَـحُـكَ فَـانْـظُـرْ مَـاذَا تَـرى “হে প্রাণ প্রিয় পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। সুতরাং তুমি চিন্তা ভাবনা করে দেখ এবং এ স্বপ্নের ব্যাপারে তোমার অভিমত কি তা বল”( সূরা আস-সাফফাত-১০২)। যেমন বাপ, তেমন বেটা। পুত্রও ছিলেন যেন হযরত ইবরাহীম আ. এর ছাঁচে গড়া, কেননা তিনি ও ভাবী নবী। তাই তৎক্ষণাৎ আত্মসর্ম্পনে মস্তক অবনত করে পুত্র জবাবে বললেন : قَالَ يـاَبَتِ افْـعَـلْ مَا تُـؤْمَرُ- سَـتَـجِـدُ نِىْ اِنْ شَـاءَ اللهُ مِنَ الـصّـبِـرِيْـنَ “হে আমার পিতাজী! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন” (সূরা আস সাফ্ফাত-১০২)।
আমরা বাংলাদেশের বেশীরভাগ মুসলমান পশু জবেহ করি ঠিকই কিন্তু মনের পশুত্ব কোরবানি করতে পারি না।
যে মানুষ প্রতিদিন হত্যা করে অন্য মানুষের আশা ভরসা স্বপ্ন ভবিষ্যৎ সেই মানুষ আবার পশু কোরবানি দেয়। কি অদ্ভুত এবাদত বাংলাদেশের মানুষের।
একটা পশুর গড়ে দাম ১ লক্ষ টাকা। সেই টাকা খরচ ক’রে কোরবানি দেয় চুরির টাকা দিয়ে। দখলবাজির সম্পদ দিয়ে।
লোক দেখানো কোরবানি।অথচ কত মানুষ আধাপেট খেয়ে অবহেলায় বেঁচে থাকে।কোরবানিদাতারা ব্যাংকে টাকা জমিয়ে রাখে। মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে এবাদতের নামে নাটক রচনা করে।