মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: কারবালা আরবি ‘কারব’ ও ‘বালা’–এর সরলরূপে পরিণত। ‘কারব’ মানে সংকট, ‘বালা’ মানে মুসিবত। তাই কারবালা সংকট ও মুসিবতের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কারবালার এ হৃদয়বিদারক ঘটনা মহিমাময় মহরম মাসের ঐতিহাসিক মহান আশুরার দিনে সংঘটিত হওয়ায় এতে ভিন্ন মাত্রা যোগ হয়েছে। এতে এ শাহাদাতের মাহাত্ম্য যেমন বহুগুণ বেড়েছে, তেমনি আশুরা পেয়েছে ইতিহাসে নতুন পরিচিতি।
প্রিয় নবীর সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত আলী (রা.)–এর আদরের দুলাল, জান্নাতি রমণীদের সরদার নবীনন্দিনী হজরত ফাতিমার নন্দন, জান্নাতি যুবকদের সরদার, বিশ্ব মুসলিমের নয়নমণি হজরত হোসাইন (রা.) আশুরা দিবসে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদি বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন। এ নির্মম ঘটনা বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে।
বাষট্টি হিজরি সনের মহরম মাসের ১০ তারিখ শুক্রবার হজরত হোসাইন (রা.) অত্যন্ত করুণভাবে শাহাদাতবরণ করেছিলেন। জগতের জানা ইতিহাসে এটি একটি বিয়োগান্ত ঘটনা।
ফোরাত’ কুফার একটি সুপ্রাচীন নদী। এ নদীর কূলে অবস্থিত কারবালার প্রান্তর। হোসাইনি কাফেলা যখন কারবালায় অবস্থান করছে, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস এই ফোরাত নদী, যা উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে রাখে, অবরুদ্ধ করে রাখে নিরস্ত্র অসহায় আহলে বাইতকে। এ নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে ফুলের মতো নিষ্পাপ দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর এক ফোঁটা পানির জন্য সীমার বাহিনীর তিরের আঘাতে শহীদ হয়। সেদিন ফোরাতকূলে ‘পানি! পানি!’ বলে অবর্ণনীয় মাতম উঠেছিল।
কুফা’ ইরাকের একটি বিখ্যাত শহর। পরবর্তীকালে হজরত আলী (রা.)-এর শাসনামলে খেলাফতের রাজধানী। আখেরি নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় মুসলিম শাসনের প্রাণকেন্দ্র ছিল মদিনা মুনাওয়ারা। নবীজি (সা.)-এর ওফাতের পর প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) প্রায় আড়াই বছর খেলাফত পরিচালনা করে ইন্তেকাল করেন। এরপর দ্বিতীয় খলিফা হজরত উমর ফারুক (রা.) ১০ বছর খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে শহীদ হন। তৃতীয় খলিফা হজরত উসমান গনি (রা.) ১২ বছর খেলাফত পরিচালনা করে শাহাদাতবরণ করেন। এ সময় পর্যন্ত ইসলামি খেলাফতের রাজধানী ছিল মদিনা। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) দুই বছরের শাসনামলে বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হলে প্রশাসনিক সুবিধা বিবেচনায় তিনি খেলাফতের রাজধানী ইরাকের কুফায় স্থানান্তর করেন। এ সময় কুফা ছিল একটি প্রদেশ এবং কুফার গভর্নর ছিলেন উবায়দুল্লাহ ইবনে জিয়াদ। তঁারই নেতৃত্বে কারবালার নির্মম ঘটনা সংঘটিত হয়। এই কুফাই পরবর্তীকালে ইসলামের ইতিহাসে ‘কুফা’তে পরিণত হয়েছে। কুফাবাসী ইয়াজিদের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য হজরত হোসাইন (রা.)-কে শত শত পত্রের মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানায়। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে তিনি সেখানে আগমন করলে তারা তাঁকে একাকী বিপদের মুখে ফেলে রেখে নিজেরা নীরব ও নিষ্ক্রিয় থাকে।
দামেস্ক’ বর্তমানে সিরিয়ার রাজধানী। চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর শাহাদাতের পর হজরত হাসান (রা.) তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং ছয় মাস খেলাফতের দায়িত্ব পালন করে সিরিয়ার গভর্নর হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর কাছে খেলাফতের ভার অর্পণ করেন। হজরত মুয়াবিয়া (রা.) প্রশাসনিক সুবিধার্থে রাজধানী দামেস্কে স্থানান্তরিত করেন। সে সূত্রে ইয়াজিদ ক্ষমতাসীন হলে তার রাজধানী দামেস্কেই রয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে কালক্রমে ইসলামি খেলাফতের রাজধানী তুরস্ক ও মিসরে স্থানান্তরিত হয়। মিসর থেকেই ১৯২৪ সালে ইসলামি খেলাফতের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ও যবনিকাপাত ঘটে।
হোসাইন ইবনে আলী (রা.) চতুর্থ হিজরির শাবান মাসের ৫ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। আর আশুরার জুমার দিনে ৬১ হিজরিতে তিনি শহীদ হন।
শাহাদাতের পর হজরত হোসাইন (রা.)-এর দেহ মোবারকে মোট ৩৩টি বর্শা ও ৩৪টি তরবারির আঘাত দেখা যায়। শরীরে ছিল অসংখ্য তীরের জখমের চিহ্ন। তার সঙ্গে মোট ৭২ জনকে হত্যা করে ঘাতকরা।
তাকে সিনান ইবনে আবি আনাস নাখায়ি হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে খাওলি ইবনে ইয়াজিদ আসবাহি হিময়ারি।
সে হোসাইন ইবনে আলীর মাথা শরীর থেকে দ্বিখণ্ডিত করে এবং ওবায়দুল্লাহর দরবারে নিয়ে যায়।
বলাবাহুল্য যে, কারবালার প্রান্তরে সে অশুভ দিনে পাপিষ্ঠরা যে নির্মমতা ও নির্দয়তার পরিচয় দিয়েছে, তা পাষণ্ড হৃদয়েও ব্যথা ও যাতনা সৃষ্টি করে।
আল্লাহ পাক আমাদের কারবালার ঘটনা থেকে ইসলামের আদত শিক্ষা দান করুন।