ঈদে সোয়া কোটি পশুর চাহিদা। চাহিদার তুলনায় গরু ছাগল রয়েছে বেশি। এবার দেশের খামারে উৎপাদিত গবাদি পশু দিয়ে কোরবানির প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে গবাদি পশুর উৎপাদন বাড়ায় কোরবানিতে চাহিদার সবটুকু পূরণ হবে দেশী গরু-ছাগল দিয়ে। এ কারণে গরু-ছাগল আমদানি পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করে কোরবানির আগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে। পৃথিবীর শীর্ষ মাংস উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার গরু রফতানির প্রস্তাবও এ কারণে নাকচ করে দিয়েছে সরকার। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকেও কয়েক বছর যাবত গরু আমদানি করা হচ্ছে না। উৎপাদন বৃদ্ধি ও দেশের খামার বিকশিত করার লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ভাল দাম পাওয়া, খামার মালিকদের প্রণোদনা প্রদান এবং সরকরাী নীতিগত সহায়তা অব্যাহত থাকায় গবাদি পশুতে বর্তমানে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। কোরবানিতে ৪৫-৫০ লাখ গরু এবং ৭০-৭৫ লাখ ছাগল ও ভেড়ার চাহিদা রয়েছে। চাহিদার প্রায় সোয়া কোটি পশুর পুরোটাই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হবে। দেড় মাস বাকি থাকতেই এবার কোরবানির গরু-ছাগল ও ভেড়া বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন খামার মালিকরা। এবার কোরবানিতে গবাদি পশু সঙ্কটের কোন আশঙ্কা নেই বলে দাবি করেছে প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
সূত্রমতে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির অন্যান্য খাত যখন চাপের মুখে ঠিক তার বিপরীত অবস্থা বিরাজ করছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে। প্রতিবছর এ খাতে যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার খামারের সংখ্যা। চাকরির পেছনে না ঘুরে এখন শিক্ষিত বেকাররা খামার করে পশু লালন-পালনে এগিয়ে আসছেন। এ কারণেই গবাদি পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। শুধু কোরবানি নয়, সারাবছরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংস রফতানি করারও উদ্যোগ নিচ্ছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে হালাল মাংস আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ।
শুধু তাই নয়, পশু পালনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা ও শক্তিশালী হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ খাতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। কয়েক বছর আগে মাংসের চাহিদা মেটাতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে ৫৫-৬০ হাজার কোটি টাকার গরু ও ফ্রোজেন মাংস আমদানি করা হতো। নিজস্ব উৎপাদন বাড়ায় এখন আর আমদানির তেমন প্রয়োজন হয় না। ফলে আমদানিতে ব্যয়কৃত অর্থের পুরো অংশ দেশেই থাকছে। প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কৃষি খাতে সর্বোচ্চ ভর্তুকি ও প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। বিশেষ করে সরাসরি ফ্রোজেন মাংস ও গরু আমদানি পুরোপুরি নিরুৎসাহিত করে এর ওপর অতিরিক্ত শুল্কারোপ করা হয়েছে। এতে করে মাংস আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। সরকারের নতুন এই নীতি সহায়তার কারণে দেশীয় খামার বৃদ্ধির পাশাপাশি পশুপালন বাড়বে বলে সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক বৈঠকে জানিয়েছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম।
চাহিদার তুলনায় বেশি পশু রয়েছে , এবার কোরবানির চাহিদার তুলনায় দেশে গরু ও ছাগল বেশি উৎপাদন হয়েছে বলে দাবি করেছেন খামার মালিকরা। করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ গবাদি পশুর কোরবানি হলেও এবার বেশি হবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স এ্যাসোসিয়েশন। সংস্থাটির তথ্যমতে, দেশে এবার কোরবানিযোগ্য গবাদি পশু রয়েছে ১ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে কোরবানিযোগ্য গরু রয়েছে ৫৫ লাখ এবং ছাগল ভেড়া ও মহিষ রয়েছে ৯৫ লাখ। যদিও করোনা পরিস্থিতির কারণে গত বছর ১ কোটি ২০ লাখ গবাদি পশু কোরবানি করা হয়েছিল। এবার পরিস্থিতির উন্নতি হলে কোরবানির পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে হাটে গরুর কোন সঙ্কট হবে না বলে জানিয়েছেন খামার মালিকরা। ফরিদপুরের নগরকান্দায় গরু ও ছাগলের খামার গড়ে তুলেছেন জুলেখা বেগম। তিনি জানান, কোরবানি সামনে রেখে গরু-ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। খামার বাড়াতে হলে গবাদিপশুর ভাল দাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারী নীতিগত সহায়তা ও প্রণোদনা বাড়ানো প্রয়োজন। উদ্যোক্তাদের মতে, সারাদেশের প্রতিটি জেলা-উপজেলা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে খামার গড়ে তোলা হচ্ছে।
সাড়ে ১২ লাখ খামারে গবাদি পশু পালন ,ছোট বড় মিলিয়ে দেশে এখন সাড়ে ১২ লাখ খামারে গবাদি পশু লালন পালন করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। ভাল দাম পাওয়া এবং সরকারী নীগিতগত সহায়তার কারণে প্রতিবছর প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ হারে গবাদি পশু পালনের জন্য খামার বাড়ছে। আর এক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে শিক্ষিণ তরুণ বেকাররা। চাকরির পেছনে না ছুটে তারা এখন নিজেরাই কিছু করার চেষ্টা করছেন। এক্ষেত্রে সফল হওয়ার দৃষ্টান্তও উল্লেখযোগ্য। আগে পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, নাটোর এবং সীমান্ত জেলাগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদি পশু পালন করা হলেও এখন সারাদেশে খামার গড়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলের বাড়িগুলোতে ছোট ছোট খামার গড়ে তুলছেন সাধারণ মানুষ। এসব খামারে গরু, মহিষ ও ছাগল লালন-পালন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, গরু আমদানি কমে যাওয়ায় ভাল দাম পাওয়ার কারণে দেশী জাতের গরুর খামার করার হার অনেক বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক ভূঁইয়া সম্প্রতি বাংলাদেশের গবাদিপশুর জাতগত বৈচিত্র্য নিয়ে একটি গবেষণা করছেন। এতে বাংলাদেশের গরুর চারটি জাত বৈশ্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উন্নত জাত বলে জানানো হয়। চট্টগ্রামের লাল গরু, পাবনার গরু, উত্তরবঙ্গের ধূসর গরু ও মুন্সীগঞ্জের মিরকাদিমের গরুর মাংসের মান ও স্বাদ এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সেরা। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ২০১৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী ছাগলের সংখ্যা, মাংস ও দুধ উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশ্বিক সূচকে ধারাবাহিকভাবে ভাল করছে। এই খাতে শীর্ষে রয়েছে ভারত ও চীন। বাংলাদেশ ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়। আর ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। সামগ্রিকভাবে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশ হচ্ছে ভারত ও চীন। আর গরু-ছাগল-মহিষ-ভেড়া মিলিয়ে গবাদিপশু উৎপাদনে বিশ্বে ১২তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশের নাম।
শুধু উৎপাদনের দিক থেকেই নয়, গবাদিপশুর জাতগত বৈচিত্র্যের দিক থেকেও বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী দেশ বলছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি বিষয়ক সংস্থাসহ (এফএও) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও রাজশাহীতে ২০ হাজার খামারে প্রায় ৫০ লাখ ছাগল লালন পালন করা হচ্ছে। এসব ছাগলের অধিকাংশই বাংলাদেশী বেঙ্গল জাতের। একই সঙ্গে দেশের মাংসের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। এতে করে বিদেশী মুদ্রার সাশ্রয় হয়। ফলে গবাদিপশুর সংখ্যা বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি, বিশেষত গ্রামীণ অর্থনীতিকে বদলে দিচ্ছে। দেশের শিক্ষিত বেকার তরুণরা এখন খামার করতে এগিয়ে আসছেন। এক্ষেত্রে নীতিগত সহায়তা আরও বাড়ানো দরকার।
সামর্থ্যবান সবাই কোরবানি দিতে চান। কিন্তু দামের কারণে তা হয়ে ওঠে না। পশুর দাম কমাতে হলে আরও বেশি পরিমাণে উৎপাদনে যেতে হবে। দেশের বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীকে গবাদি পশুপালনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার বুকে জেগে ওঠা চরাঞ্চলে পশুপালনে সরকারী উদ্যোগ প্রয়োজন। তিনি বলেন, এটা ঠিক বর্তমান সরকারের বিশেষ উদ্যোগের ফলে দেশে গবাদি পশুর উৎপাদন বেড়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বড় বড় খামার। এসব খামারির যাতে কোন লোকসান না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, কোরবানির হাটের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চাঁদাবাজি বন্ধ এবং ট্যাক্স কমানো প্রয়োজন। গরু বিক্রির ওপর সারাবছর শতকরা ৩ টাকা ট্যাক্স নেয়া হলেও কোরবানির সময় তা ২ টাকা বাড়িয়ে ৫ টাকা করা হয়। এতে কোরবানির পশুর দাম বেড়ে যায়। পশুর দাম কম হলে সাধারণ মধ্যবিত্ত মানুষ কোরবানি দেয়ার সুযোগ পাবেন।