সখি!যে কাজলে নয়ন আঁকিয়া
জ্বালালে প্রেম চেরাগ
সেই ‘কাজলের কালি’ দিয়ে দাও
মোর কলিজায় দাগ।
তোমার নয়নে নয়ন রাখিয়া,দেখি
মুখ-ছায়া-ছবি,
হরনিশি উষা লগন আমার
হরনিশি জাগে রবি।
মোর আঁখিপাতে ঘন কালো মেঘ
তব আঁখিপাতে জল
মেঘ মেদুর ঘন বরষা বিহীন
ঝরে কেন অবিরল!
ভালোবাসা সেই গন্ধ ফুলের
যে ফুল ফোটে না বনে,
দূর থেকে দেখা জোনাকির আলো
সৈকতে ঝাউবনে।
চোখের নেশার ভালোবাসা সখি
বেসুরো বাঁশের বাঁশরী
খেলো হোলি হ’য়ে অন্তরাত্মা’য়
শত রঙ মাখা কিশোরী!
ভালোবাসা নহে শ্রাদ্ধ। কোনো
চিতাখোলা নহে প্রাণ,
দিলে দিও সব উজাড় করিয়া
হয় হলে হবে প্রয়াণ।
আজি হইতে শত বর্ষ আগে —
শিক্ষক ছিলেন অগ্রপথিক,
জাতির অগ্রভাগে।
শিক্ষা ছিলো মানবমুখি,জাতির মেরুদণ্ড,
শিক্ষিতজন শিষ্টাচারী শক্তিমান প্রচন্ড।
দলে দলে সবে গুরুগৃহে যেতো অন্বেষণে জ্ঞান,
গুরু গৌরবে সৌরভ তাঁর সুলভে করিতো দান।
নত মস্তকে হস্ত প্রসার করিয়া গুরুর পায়,
জ্ঞানে মগ্ন হইতো শিষ্য জ্ঞানের অন্বেষায়।
যাহারা যত বৃহৎ হইতো বিনয়ী হইতো ততো,
গুরু-শিষ্যের দক্ষিণা নিতো মান রেখে অক্ষত।
গুরু গৃহে শিষ্য,গুরু খেদমতে হইতো যত্নবান,
গুরু জ্ঞান তাঁরা ধারণ করিয়া সমাজে করিতো দান।
জাতে জাতে ধর্মে ধর্মে মুসলিম-হিন্দু’তে,
গুরু গৃহে মিলিত হইতো এক প্রাণ এক বিন্দুতে।
রাজকুমার আর রাজকুমারী গুরুর কদম ছুঁয়ে,
দীক্ষা নিতো,নত মস্তকে গুরু সম্মূখে নুয়ে।
ধর্মাবতার রাজ কারবার গুরুমুখে স্থির,
এমন-ই এক জগৎ,নজির বাদশাহ আলমগীর।
কেন কেবল জল ঢালিলো পুত্র গুরুর পায়,
গুরুর চরণ সবার শীর্ষে বড়ই মহিমাময়।
বাদশাহ কহিলো,”জল কেন শুধু ঢালিলো গুরুর পায়”?
“শিষ্য হস্তে ধুইলোনা পা, মরি মরি হায় হায়”!
ধীরে ধীরে যত জ্ঞান-বিজ্ঞান করিলো প্রসার লাভ,
শিষ্য বিরাট বিজ্ঞানী;ক্ষত মাষ্টারের স্বভাব!
শিক্ষা হইলো চুক্তিভিত্তিক দিনমজুরের কর্ম,
চুক্তি করিয়া শিক্ষক তাঁর খোয়ায় আপন মর্ম।
মর্যাদা-মান শিক্ষা কি আর চুক্তিভিত্তিক হয়?
গুরু সৌরভ শিষ্যের মাঝে ছড়ায় জগৎময়।
গুরু বড় স্পর্শকাতর,গুরুত্বপূর্ণ অতি,
শিষ্যের মুখে জ্বলিয়া ওঠে গুরুবিদ্যার জ্যোতি।
পন্ডিতেরাই পন্ড কেন?ভণ্ড বুদ্ধিজীবি?
ধন ধ্যানে প্রাণে বিত্ত,অর্থশালী কবি?
যে কবি দিবসে মনের হরষে গাহিছে আপন গান,
সে নহে মোটে বিদ্যাপতি,,সে নহে বিদ্যান।
শিক্ষা যদি ভিক্ষা শেখায়,দীক্ষা শূন্য সার,
শিক্ষকের কি মান রবে?কে বুঝবে কদর তাঁর?
আজি হইতে শতবর্ষ পরে —
উচ্চ মূর্খ মাষ্টারেরা কি পড়াবেন ঘরে ঘরে?
লক্ষ্য আর উদ্দেশ্য যদি ব্যক্তি স্বার্থে হয়,
শিক্ষা-ই কি,ধর্ম-ই কি, হাসিল হবার নয়।
মূর্খ জ্ঞানী,মূর্খ ধ্যানী – মূর্খ বিচক্ষণ ,
কোন বিদ্যানে মূর্খ সঙ্গে করিবে আলিঙ্গন?
মূর্খ নেতার যাতাকলে প’ড়ে জনগণ মৃতপ্রায়,
মূর্খ মানব দানব সম গুণীজনে তাহা কয়।
মূর্খ মাষ্টার,শিষ্টাচারে’ বোঝার দায় কি নেবে ?
কর্মকারে সোনার মূল্য কখনো কি আর দেবে?
যাঁহার কর্ম করিলে তিনি,সরলে সহজ হয়,
কামার গৃহে ক্বোরআন পঠন মোটে সমীচীন নয়।
আমার কর্ম আমি ক’রে যাই শুনিলে শুনুন সবে,
সবার কথা শোনে কি সবাই,কুশিক্ষা ভরা ভবে?
ভুখা মাষ্টার জ্ঞান-গরিমার স্রষ্টা কেমনে হবে?
সবাই যখন পেটপুরে খায় গুরু কেন ভুখা রবে?
সবাই মানুষ গুরু কি তবে মানুষ মোটেই নয়?
পথে প্রান্তরে মার খাবে গুরু কেমন করিয়া হয়?
শিক্ষকের কি প্রাণ নাহি?না কি মানুষের মত কিছু?
সবার যখন উঁচু মস্তক শিক্ষকে কেন নিচু?
মানব দানব হইলে কি আর নীতিকথা ভালো লাগে?
পাপ পরিহাস নির্মম-ই হয় পাপী যবে আগেভাগে।
আবার যদি গুরু-শিষ্যে জ্ঞানের মিলন হয়,
আবার আমরা জাগিবো,আলো ছড়াবে জগৎময়।
আলো-আলেয়ায় হয় না মিলন তাপিতা জাহান্নামে,
নাচিয়া গাহিয়া উঠুক সবাই শিক্ষক সম্ভ্রমে।
যেখানে পাশে ছিল অনন্ত প্রেম,
সেখানে যাবো না আমি শুধালেম।
ঘুনপোকা ধীরে ধীরে গ্রাস করে শান্তি,
ছারপোকা কেড়ে নিলো জাগতিক স্বস্তি।
যেখানে পাবার কথা একশোতে একশো
সেখানে চল্লিশ – ষাট হলো ভস্ম।
ঘুনপোকা ধীরে ধীরে গ্রাস করে শান্তি,
ছারপোকা কেড়ে নিলো জাগতিক স্বস্তি।
যেখানে হবার কথা রিমঝিম বৃষ্টি,
সেখানে কেমনে হয় মরুভূমি সৃষ্টি।
ঘুনপোকা ধীরে ধীরে গ্রাস করে শান্তি,
ছারপোকা কেড়ে নিলো জাগতিক স্বস্তি।
আমি আজ শুধু ভাবি;
আমি নীল সাগরের মাঝি,
চারিপাশে জলরাশি;
এক্ষুনি সাইক্লোন এল বুঝি।
আমাকে ভয় পেলে চলবে না, একদম না।
পথ আমি কোন ভাবে হারাবো না, একদম না।
অনেকেই ভাবে আমি অগোছালো,
আমি তা একদম না।
কেউ কেউ হয়ত ভাবে আমি অহংকারি,
ঠিক না, একদম না।
আমি শুধু সততায় সম্মোহিত,
ভন্ডামী সহ্য করিনা, একদম না।
তাই কেউ আমাকে ভুল বুঝো না,
একদম না। একদম না।
এস এম জাকির হোসেন:
(২য় পর্ব)
জ্বলন্ত অগ্নিকূপে কয়েকদিন-
পরের দিন। রাতের আঁধার তখনও পুরোপুরি কাটেনি। বাবা ঘরের ভেতরেই ফজরের নামাজ পড়ে নিলেন। সামনের ঘরে এসে জানালার পর্দা একটু সরিয়ে বাইরে তাকালাম। চারিদিকে কোনো সাড়াশব্দ নেই, জনশূন্য রাস্তা। এ সময় সাধারণত ফজরের নামাজ শেষে মুসুল্লিরা ঘরে ফেরে। আজ রাস্তায় মুসুল্লিদের কাউকে চোখে পড়লো না। তাহলে কি আজ মসজিদে নামাজ পড়তে কেউ যায়নি! গতরাতে যা ঘটলো, তাতে কারো বাইরে বের হবার কথাও নয়। ভেতরের রুমে ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে আমাদের ঘুমানোর চেষ্টা চললো কিছুক্ষণ। ঘুম কী আর আসে? মাথায় কেবল একটাই চিন্তা কখন এখান থেকে বের হয়ে মেজ চাচার বাসায় যাবো।
কিছুটা আলো ফুটতেই আবার সামনের রুমে চলে এলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি তখনও রাস্তাঘাট খাঁ খাঁ করছে। দেখে মনে হচ্ছেÑ যেনো একটা মৃত নগরী। গতরাতের তা-বে মানুষ এতটাই ভয় পেয়েছে যে কেউ আর ঘরের বাইরে বেরুতে সাহস করছে না। আমারও বাইরে যাওয়ার সাহস হলো না আর। ছোট মামা মৃদু ভলিউমে রেডিওটা চালাচ্ছে। কোনো শব্দ নেই। ভেবেছিলাম অবস্থা একটু শান্ত হলে এখান থেকে চলে যাবো। সারারাতের ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। বাবা মা, রানু কেউ আর আমাকে ডেকে তোলেনি। ঘুম ভাঙলো ন’টায়। আসাদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাইরের অবস্থা কেমন?’
সে ছোট করে বললো, ‘মৃত্যুপুরী।’
আমি জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি অবস্থা তখনও থমথমে। ছোট মামা রেডিওটা নিয়ে নড়াচড়া করেই যাচ্ছিলো। নব ঘোরাতে ঘোরাতেই যন্ত্রসঙ্গীত ভেসে আসলো। শধুই যন্ত্রসঙ্গীত।
বাইরে যাবার উপায় নেই। চারিদিকে কি হচ্ছে কিছুই জানতে পারছি না। রেডিওতে কোনো খবর নেই। একটা চরম অস্থিরতার মধ্যে সময়টা কাটছিলো। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার আমাদের বাসাটা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছে ছিলো। কোনো কারণে পাকিস্তানি আর্মিরা এদিকে ঢুকে পড়লে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতাম। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না তখন। রেডিওটা খুব লো ভলিউমে অন করাই ছিলো। হঠাৎ যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হয়ে গেলো। উর্দুতে কি জানি বলছে। আমি উর্দু ভালো বুঝি না, তবে কার্ফ্যু কথাটা বুঝলাম। একটু পরেই অবশ্য ইংরেজিতে বলতে শুরু করলো।
অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারী করা হয়েছে। একটা একটা করে কারফিউর নিয়মকানুনগুলো পড়ে শোনানো হচ্ছিলো। কারফিউ ভঙ্গ করে বাইরে গেলে কি কি শাস্তি, তা ও জানানো হলো। মাকে বলতেই তিনি চুপ করে রইলেন। কিছুক্ষণ পর মা বললেন, ‘সুরুজ, তাইলে এহন উপায়? আমাগো তো এইহান থেইক্যা তাড়াতাড়ি চইলা যাওন দরকার।’
ছোট মামা তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করো না বুবু, সবার যা হইবো আমগোও তাই।’
মা রানুর দিকে তাকিয়ে থাকলো অনেকক্ষণ। রানু দেখতে খুব সুন্দর ছিলো। তার যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে মায়ের খুব খেয়াল ছিলো। মা রানুকে বললেন, ‘বউ তুমি আর সামনের ঘরে যাইবা না। কোনো কিছুর দরকার অইলে আমারে কইবা। এই কার্ফু টার্ফু শ্যাষ অইলে আমরা আর এইহানে থাকমু না।’
আসাদ ভাই ক্ষিপ্ত হয়ে বললো, ‘হারামজাদা সামরিক সরকার আবার ‘মার্শাল ল’ জারি করছে। বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু ওরা জানে না, এই বাঙালি জাতিরে দমাইয়া রাখা এত সোজা না।’
এতকিছুর মধ্যে বাবার তেমন কোনো ভূমিকা ছিলো না। চুপচাপ দাদার শিয়রের কাছে বসে রইলেন। মায়ের কথামতো রানু সব কাজ করে যাচ্ছিল ঠিক, তবে তার দেহে যেনো প্রাণ ছিলো না। যেনো আতঙ্কিত একটি প্রাণি প্রবল ভয়ে ছটফট করছে। আসলে আমাদের কারও কিছু করার ছিলো না তখন। কে কাকে সান্ত¡না দেবে? মা হঠাৎ নিচু কণ্ঠে বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ‘দেশ ভাগের আগে হুনছি সাদা বিলাতি খেরেস্তানরা মানুষের উপর অত্যাচার করছে কিন্তু অ্যারা তো মোসলমান, মোসলমান হইয়া অ্যারা ক্যান অন্য মোসলমানগো এমন কইরা মারতাছে?’
আমি আমার মায়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছিলাম, আমার অল্পশিক্ষিত মা’ও দেশ নিয়ে কত ভাবে! মায়ের কথার উত্তরে বাবাও নিচু গলায় জবাব দিলেন, ‘অ্যাগো কাছে হিন্দু মোসলমান খ্রীষ্টান কোনো ব্যাপার না, মূল কথা অইলো গিয়া ক্ষমতা। অ্যারা শ্যাখ সাইবের কাছে ক্ষমতা ছাড়বে না এইজন্যই এতো হানাহানি।’
আসাদ ভাই ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললো, ‘কতদিন ক্ষমতা ধরে রাখবে? একদিন না একদিন ছাড়তেই হবে।’
বাবা আবার বললেন, ‘আমি ভাবতাছি শ্যাখ সাইব অ্যাগো লগে যুদ্ধ করবে কি দিয়া? শয়তানগুলান আমগো জোয়ানগো তো মাইরা সাফ কইরা দিবে। ওরা এত অস্ত্র পাইবো কই?’
এই পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া একটু থামলো।
দীপু সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করলো, ‘তারপর কি হলো দাদা?’ বৃদ্ধ হেসে বললো ‘সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আইজ এই পর্যন্তই থাক।’
দিনের আলো কমে গিয়ে চারদিক থেকে একটা আবছায়া আঁধার নেমে এসে সবকিছু যেনো গ্রাস করে নিচ্ছিলো। তপু একটু দূরে নদীটির দিকে তাকায়। অস্তগামী সূর্যের লাল আভা পড়েছে নদীর পানিতে। এমনিতে এই সময়টা তার ভীষণ প্রিয়। এই মুহূর্তে নদীটা যেনো তাকে প্রবলভাবে টানছে। বৃদ্ধ তপুকে ও’দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো, ‘এই যে নদীটা দেখছো, এ তো মেঘনার কাছে কিছুই না। কী বিশাল আর প্রমত্তা মেঘনা! চারদিকে কোনো কূল কিনারা ছিলো না। রাক্ষুসে একেকটা ঢেউ উঠতো! যেনো গিলে খাবে আমাদের। আমরা একখ- পাটকাঠির মতো ভেসে চলছিলাম কেবল।’
তপু উঠে দাঁড়ায়। দাদার উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুমি নামাজ পড়া শেষ করো, আমরা এই ফাঁকে নদীর পাড় থেকে ঘুরে আসি। তারপর আবার শুরু হবে কাহিনী।’
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া নাতির দিকে তাকিয়ে হাসে। এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও তাহলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে চায়! এটা অবশ্যই শুভ লক্ষণ। তপু নদীর দিকে চলে গেলে বৃদ্ধ ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
সন্ধ্যার পর সামনের বারান্দায় বসে আবার শুরু হলো গল্পের আসর। আসরের মধ্যমণি সেই বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া। বিকালের চেয়ে এখন শ্রোতার সংখ্যা বেশি। বাড়ির সব ঘর থেকেই লোকজন এসে হাজির হয়েছে। বাইরে হালকা আলো আঁধারি ভাব। সামনের বারান্দার বাতি নিভিয়ে শুধুমাত্র ভেতর ঘরের একটা লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয়েছে। সে আলোয় সামান্য আলোকিত হয়েছে আসরের জায়গাটি। দখিণের জানালা দিয়ে নদীর উপর থেকে ছুটে আসা ঠান্ডা হাওয়া ঘরটাতে একটা হিমেল পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া আবার শুরু করলো
সেদিন সারাক্ষণই সবাই খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে কাটালাম। রানুর মধ্যে এক ধরনের অপ্রকৃতিস্থতা লক্ষ করলাম। কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো সারাদিন। আমরা কোনরকমে খাওয়া দাওয়া সারলাম। না খেলেই নয় তাই হালকা কিছু রান্না হয়েছিলো। আসলে পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য খাওয়া। আসাদ ভাই অনেক বুঝিয়েও ওকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
মা এমনিতে খুব শক্ত মনের মানুষ। সহজে ভেঙে পড়েন না। কিন্তু হঠাৎ তাকে দেখেও চিন্তিত মনে হলো। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ‘শিউলিগো যে কী অবস্থা কেডা জানে!’

আমি বললাম, ‘আমিও ভাবছিলাম বড় আপাদের কি অবস্থা। আমরা যে মেজ চাচার বাসায় যাচ্ছি তাও তো ওরা জানবে না। আসাদ ভাই আর ছোট মামার সাথে আলাপ করে দেখি।’
আসাদ ভাই আর ছোট মামা একই কথা বললেন। এখন কিছু করার নেই, মেজ চাচার বাসায় গিয়ে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। মা বুঝলেন এই মুহূর্তে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া জরুরি। রাজারবাগ পুলিশ লাইন তখন পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম এই এলাকা থেকে যত দ্রুত সম্ভব সরে পড়তে হবে। আমরা শুধু ঘোষণার অপেক্ষা করছিলাম কখন কারফিউ শিথিল হয়।
পরদিন সকালে কারফিউ তুলে নেয়া হলো। গোছগাছ আগে থেকেই করা ছিলো। জিনিসপত্র আর কী? অতি প্রয়োজনীয় কিছু কাপড়চোপড়, রানুর গহনা আর অনুর দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী। মা আর রানুকে তাড়া দিলাম। বাদবাকি সবকিছু দ্রুত গুছিয়ে নেয়ার কথা বলে বাইরে এলাম একটু খোঁজ-খবর করার জন্য। গলির মোড়ের দোকানটাও বন্ধ। লোকজন কাউকে চোখে পড়লো না সেখানে। আরেকটু সামনে এগোতেই পরিচিত দু’জনের সাথে দেখা মিললো। তাদের মুখে যা শুনলাম তাতে আমার ভিমড়ি খাওয়ার দশা। ঢাকার উপর সে রাতে যেনো নরক নেমে এসেছিলো। রাজারবাগ পুলিশ লাইন দখল করে নিয়েছে হানাদার পাকিস্তানিরা। বাঙালি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা প্রাণপণে লড়াই করেছে কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ভারী অস্ত্রসস্ত্র, ট্যাঙ্ক কামানের আক্রমণে বেশিক্ষণ টিকতে পারেনি।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলাকায় নারকীয় তা-ব চালানো হয়েছে। ইউনিভার্সিটির হলগুলোতে ঢুকে ছাত্র শিক্ষকদের নির্বিচারে গুলি করে মেরেছে। শহিদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার, বস্তি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে; পুরনো ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা পুড়িয়ে ছারখার করেছে সারারাত ধরে। সেদিন সব খবর জানা যায়নি, পরে জেনেছিলাম আসলে সে রাতে ঢাকায় একটি পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছিলো; লাশের স্তূপ জমেছিলো ঢাকার রাস্তায় রাস্তায়।
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া আবার থামলো। তপু বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে দাদার দিকে। এর আগে শুধু বই পড়েই তপু জেনেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তবে আজকের এই গল্পের আসর একেবারেই আলাদা। একাত্তরের একজন জ্বলন্ত সাক্ষী ওর দাদা, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে; তাঁর মুখে শুনছে সেই সময়ের দিনিলিপি, দাদার জীবনের গল্প। এটা কী কম সৌভাগ্যের ব্যাপার! সুরুজ মিয়াও দেখছিলো নাতিকে। তাঁর আগ্রহ দেখে আবার শুরু করলো, ‘আমি তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে এলাম। কিছু নেই বললেও তিন তিনটে ব্যাগ! খুব দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পেছনের গলিটার শেষ মাথাটা বড় একটা রাস্তার সাথে মিশেছে। ওখানে গিয়ে দেখি অগণিত মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে।পিঁপড়ার মতো দলবেঁধে তারা ছুটছে। ছেলে বুড়ো শিশু, চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে প্রাণটা হাতে করে যেনো ছুটছে সবাই। আশেপাশে রিক্সা বা অন্য কোনো যানবাহন নেই। অগত্যা হেঁটে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। সামিল হলাম সেই মানুষের মিছিলে। মা আনুকে কোলে তুলে নিলেন, আমি দাদাকে কাঁধে নিলাম আর আসাদ ভাই, ছোট মামা আর বাবা ব্যাগগুলো বয়ে নিয়ে চললেন। আমাদের এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে গেলো মেজ চাচার খিলগাঁওয়ের বাসায় পৌঁছতে।’
এস এম জাকির হোসেন
পল্লবী, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
চিরদিন প্রকাশনী
-এস এম জাকির হোসেন:
ভূমিকা:
উপন্যাসের শুরুটা একাত্তরের পঁচিশে মার্চ মধ্যরাতের ঘটনা নিয়ে। যখন পাক হানাদার বাহিনী সারা ঢাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেÑ ঠিক সেই মুহূর্তের চিত্র। এই লেখায় মূলত যে গল্পটি বলার চেষ্টা করা হয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। একটি যুদ্ধ নানানভাবে মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে, যার কোনোটিকেই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত থেকেই নিজেদের পরিবারকে বাঁচানোর তাগিদে মানুষ ঢাকা শহরের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটে বেড়িয়েছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ফিরে গেছে নিজ গ্রামে। এই গল্পে তেমনই কিছু মানুষের জীবনযুদ্ধের ঘটনাবলী তুলে ধরা হয়েছে। গল্পটি মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের একটি খণ্ড চিত্র মাত্র। নিজেদের পরিবারকে বাঁচাতে নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও প্রতিকূল সব পরিস্থিতি পেরিয়ে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে ছত্রিশ জনের দলটি ফিরে চলে তাদের গন্তব্যে। এটা মোটেও কোনো সহজ কাজ ছিলো না। একাত্তরে এভাবেই অসংখ্য মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পথে নেমেছিলো। দুর্গম সেই পথের শেষে তাদের কেউ কেউ হয়তো ফিরতে পেরেছিলো কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়, কারো কারো স্থান হয়েছে সীমান্তের ওপারে শরনার্থী ক্যাম্পে; আবার অনেকের জীবনে নেমে এসেছিলো করুণ পরিণতি। এটাই মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা।

এক
শরতের এক রোদেলা দুপুরে সাঁতার না জানা ছোট্ট নাতিটিকে বাঁচাতে একমাত্র ভাইয়ের জোয়ান ছেলেটা যখন পুকুরে ঝাপ দিলো, ঠিক সেই মুহূর্তে চকিতে আরেকটি দৃশ্য মনে পড়ে গেলো বৃদ্ধ সুরুজ মিয়ার। সম্মুখ যুদ্ধের অগ্নিঝরা দিনগুলো ছাড়াও, সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় ভরা কয়েকটি দিনের ছবি তাঁর চোখে ভেসে উঠলো। আজকের এই ঘটনা তাঁকে এক ঝটকায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলো পাঁচ দশক আগে। সেই উত্তাল মেঘনা, সেই আড়িয়াল খাঁ, ঝড় বৃষ্টি, নদীর স্রোত, নৌকাডুবি, সেদিনের সেই ছোট্ট সুমিকে স্রোতে ভেসে যাওয়া থেকে বাঁচানো, পঙ্গু-অন্ধ বৃদ্ধ দাদাকে কাঁধে নিয়ে ছত্রিশ জনের দলটির মাইলের পর মাইল হেঁটে চলা… সবকিছু মনে করিয়ে দিলো। বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে পুকুরের স্থির জলের দিকে। মনে মনে ভাবে, তার বড় ছেলের ঘরের নাতি তপু বাড়িতে আসার পর থেকেই তার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে চাচ্ছে। প্রতিদিন একই বায়না। আজ মনে হয় আর ওকে থামিয়ে রাখা যাবে না।
শেষ বিকেলের আলোটুকু ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছিলো। পড়ন্ত বেলার সূর্যটা তার তেজী রূপ হারিয়ে পূর্ণ যৌবনা নদীটার ও পাড়ের ধূসর গাছপালার প্রান্ত ছুঁয়ে হঠাৎ যেনো থমকে গিয়েছিলো। তপু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো নদীর দিকে। এখান থেকে দক্ষিণে তাকালেই নদীটা দেখা যায়। দু’শ গজের মতো ব্যবধান মাত্র। নদীর পানিতে দিন শেষে বিমর্ষ সূর্যের কোমল আলোর আশ্চর্য মায়াবী রূপ পুরোটাই চোখে পড়ে। তপু যতবার গ্রামে আসে ততবারই যেনো নতুন করে এ নদীর প্রেমে পড়ে যায়। গ্রামে আর একটি প্রিয় মুখ ওকে খুব টানে। তপুর বৃদ্ধ দাদা। এবার গ্রামে আসার পর থেকেই দাদার পেছনে আঠার মতো লেগে আছে, দাদার কাছে তাঁর জীবনের গল্প শুনবে। মুক্তিযুদ্ধের গল্প।
বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া বসেছিলো ঘরের পাশের এক টুকরো খোলা চত্বরে। গাছের ছায়ায় বিকেলের মৃদুমন্দ হাওয়ায় শরীরটাকে জুড়িয়ে নেয়ার খেয়ালে। একটা বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে তাকিয়ে ছিলো কালের সাক্ষী প্রমত্তা যৌবনা খরস্রোতা নদীটার দিকে। বৃদ্ধের সামনে বেতের মোড়ায় মুখোমুখি বসে আছে তাঁর দুই নাতি তপু আর দীপু। তপু তন্ময় হয়ে দেখছিলো ওর দাদাকে; সে যেনো হারিয়ে গেছে কোনো এক সুদূরালোকে। একটু দূরে গোয়াল ঘরের চালার উপরে হেলে পড়া বয়সী জামরুল গাছটার পাতার ফাঁক গলে মিষ্টি রোদের আলোচ্ছটা চুইয়ে এসে পড়েছে বৃদ্ধের মুখে। বিকেলের মায়াবী রোদ তপুর সত্তরোর্ধ দাদার কাশফুলের মতো সাদা চুল থেকে নেমে ভাঁজ পড়া কপাল গাল চুয়ে সফেদ শুভ্র দাড়িতে এসে থেমেছে। তখনও তাঁর দৃষ্টি ছিলো নদীর দিকে। সুরুজ মিয়া বসে বসে ভাবে ‘এ নদী গড়েছে কত ইতিহাস! বাড়ি-কে বাড়ি, গ্রাম-কে গ্রাম উজাড় হয়েছে ওর বুকে!’
আরেকটা দৃশ্য ভেসে ওঠে বৃদ্ধ সুরুজ মিয়ার মনে। বুকের মধ্যে চলমান স্রোতের শব্দ শুনতে পায়। উথাল-পাথাল ঝড়ের শব্দ। কতকাল কেটে গেছে! একটুও ম্লান হয়নি সেই স্মৃতি। এতকাল ধরে নিজের ভেতরে পুষে রাখা মাতমটা হঠাতই যেনো বাইরে বেরিয়ে আসতে চায়। সামনে বসা নাতিরা তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছে একনিষ্ঠ শ্রোতা হয়ে। সুরুজ মিয়া হারিয়ে গিয়েছিলো ইতিহাসের পাতায়। সবকিছু দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছে যেনো। কিছু বুঝতে না পারলেও দশ বছরের দীপুও প্রবল উৎসাহ নিয়ে তাকিয়ে থাকে তার দাদার মুখের দিকে।
‘সে বড় কষ্ট আর দুর্যোগের সময় ছিলো রে ভাই।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এভাবেই শুরু করলো বৃদ্ধ। সামনে একবার তাকিয়ে দেখলো শ্রোতারা গল্প শোনার জন্য কতটা উদগ্রীব। তপু দীপুর সাথে আরও কিছু নতুন মুখ এসে জড়ো হয়েছে তখন। বৃদ্ধ একটু থেমে আবার বলতে শুরু করলো, ‘তখন আমার বয়স এই ধর ত্রিশের মতো। তোদের দাদির তেইশ কী চব্বিশ, আর তোদের বাবা তখন ‘এই এত্তটুকুন’, দুই হাত কাছাকাছি এনে দেখালো বৃদ্ধ।’
দীপু উচ্চশব্দে হো হো করে হেসে উঠলো। বৃদ্ধ একটু সময় নিয়ে আবার যোগ করলো, ‘জানটারে হাতের মুঠোয় নিয়ে জ্বলন্ত অগ্নিকূপে প্রায় পনেরো দিন পার করেছিলাম। তারপর বাঁচার তাগিদে একদিন দলবলসহ ঢাকা ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির পথে, পায়ে হেঁটে।’
শ্রোতারা সব নিশ্চুপ। পরবর্তী অংশ শোনার জন্য উৎসুক সবাই।
‘আমরা তখন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের খুব কাছেই থাকতাম। শহীদবাগে। বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মাথায় আসলেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনটা দেখা যেতো।’
এই পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ আবার কিছুক্ষণ থামলো। ঘরের পাশের ছোট্ট চত্ত্বরটায় তখন পিনপতন নীরবতা। সবাই মুন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে বৃদ্ধ সুরুজ মিয়ার দিকে। এবার সে পুরো কাহিনী শুরু করলো।
কালরাতের ভয়াল থাবা
একাত্তরের পঁচিশে মার্চের রাতটা ছিলো ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্নের মতো। তখন আনুমানিক রাত বারোটার কাছাকাছি হবে। সেই রাতে আসাদ ভাই আর ছোট মামা আমার বাসাতেই ছিলো। তাই দেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো। আমরা কেবল ঘুমাতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হঠাৎ প্রচণ্ড শব্দে চমকে উঠলাম। গোলাগুলির শব্দ, মুহুর্মুহু ভেসে আসছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম গুলির শব্দগুলো পুলিশ লাইনের দিক থেকেই আসছে। গুডুম! গুড়ুম! কেঁপে কেঁপে উঠছিলো আমাদের ঘর। মেশিনগান আর কামানের আওয়াজ সব। মনে হচ্ছিলো আকাশ ভেঙে পড়বে ঘরের উপর। ঘরের আলো বন্ধ ছিলো, কিন্তু হঠাতই বাইরে থেকে জানালা গলে আসা উজ্জ্বল আলোয় আমাদের ঘরের ভেতরটা আলোকিত হয়ে উঠলো।
আনু তখন তিন মাসের শিশু। গোলাগুলির শব্দে চিৎকার করে জেগে উঠলো ও। আমরা আরও ভয় পেয়ে গেলাম। তোদের দাদি ছিলো ভীতু স্বভাবের মানুষ। সে থরথর করে কাঁপছিলো। বাবাও খুব অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। কেবলমাত্র শান্ত, স্থির ছিলেন মা। মা তখন ছুটে এসে আনুকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। বুকের সাথে এমনভাবে সাঁটিয়ে রেখেছিলেন যেনো ও কান্না না করে। তোদের দাদিকেও সাহস যোগাচ্ছিলেন মা। পুলিশ ব্যারাকের ওদিকটা থেকে থেকে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিলো। মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরেই আগুন ধরে গেছে। পরে জেনেছিলাম মেশিনগানের গোলায় ব্যারাকে আগুন ধরে গিয়েছিলো।
আমরা সবাই ভেতরের রুমে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। রানু হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমি ধমক দিলাম। একটা বালিশ এনে বললাম এটা দিয়ে কান চেপে রাখো। দেখলাম ও তাই করলো। এর মধ্যে গোলাগুলির থামাথামি নেই। অবিরাম চলছিলো। আমার পঙ্গু অন্ধ দাদা কিছুই শুনতে পাচ্ছিলেন না কিন্তু আমাদের অবস্থা দেখে ঠিকই বুঝলেন ভয়ংকর কিছু ঘটছে। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আমরা তাকে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। বাবা তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন।
আমরা আগে থেকেই আঁচ করছিলাম এরকম কিছু একটা হবে। বেশ কয়েকদিন ধরে অফিস, আদালত, রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান তখন সব জায়গায় একই আলোচনা ছিলো। কিন্তু সেটা যে এত নির্মম, ভয়াবহ আর বর্বোরোচিত হবে এটা কখনও ধারণা করতে পারিনি। থেকে থেকেই আকাশ আলোকিত হয়ে উঠছে। জানালার পর্দা ভেদ করে সে আলোয় আমাদের ঘর আলোকিত হয়ে উঠছে। মা ভেতরটা অন্ধকার করার জন্য জানালার পর্দার উপরে বিছানার চাঁদর দিয়ে দিলেন। এভাবেই ঘণ্টা দুই পার করলাম।
এখান থেকে কাছাকাছি এলাকাতেই আমাদের সব আত্মীয়স্বজনের বসবাস। তবে এই মুহূর্তে আমার বাসাটাই সবচেয়ে বিপদজনক জায়গায়। একেবারে বাঘের মুখে। আমার মনে হলো আসাদ ভাই আর ছোট মামাকে আজ আমার বাসায় আটকে রেখে ওদের জন্য বিপদ ডেকে আনলাম। ওরা শাহজাহানপুর, খিলগাঁও কিংবা গোরান যে কোনো জায়গায় থাকলে এখানকার চেয়ে নিরাপদে থাকতে পারতো।
আসাদ ভাই রানুর বড়ভাই, তবে বয়সে আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড়। ডিবি ইন্সপেক্টর, চট্টগ্রামে পোস্টিং। ঢাকায় একটা কাজে এসেছিলো কিন্তু আর ফিরে যেতে পারেননি। ছোট মামা মিজানুর রহমানের বাসা শাহজাহানপুরে। বড় আপার বাসার কাছে। তবে তার স্ত্রীও একবছর বয়সী ছেলে এখন বড় মামার বাসায় গোরানে। তাই সে স্ত্রী সন্তানের বিষয়ে কিছুটা চিন্তামুক্ত। আমি ছোট মামা আর আসাদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। নিচু স্বরে বললাম, ‘জোর করে ধরে রেখে আমি তোমাদেরকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিলাম।’
এই চরম দুর্যোগের মধ্যেও দু’জনেই নিঃশব্দে হাসলো। ছোট মামা বললো, ‘তোর কি দোষ? কোথায় কখন কীভাবে কার বিপদ আসবে কে বলতে পারে?’
আমি আর কিছু বললাম না। ছোট মামা ভেতরের রুমে চলে গেলো। মাকে বললো, ‘বুবু, আর দেরি করা যাবে না। জরুরি যা দরকার তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নাও।’
মেজ চাচার বাসা ওখান থেকে আরও কিছুটা ভেতরে; খিলগাঁও। ঠিক হলো প্রথমে ওখানে চলে যাবো, তারপর সবাই মিলে ঠিক করা যাবে পরবর্তী করণীয়।
একটু পর মা এসে জানালেন, ‘পাশের ঘরের বাসিন্দাদের লগে কতা অইছে, তারা কইছে যত তাড়াতাড়ি পারে এই জায়গা ছাইড়া চইলা যাইবে।’
‘মানে ফারুক সাহেবরা?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।
মা হাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি ফারুক সাহেবদের ঘরের দিকের জানালায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকে দেখলাম ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে। মৃদু স্বরে ডাকতেই বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। আমার মতোই অস্থির হয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলে উঠলো,
‘ভাই, অবস্থা ভালো না। এখানে থাকা কোনভাবেই নিরাপদ নয়।’
‘আপনারা নাকি আজই চলে যাচ্ছেন?’
ফারুক ভাইকে জিজ্ঞেস করতেই সে জানালো যত দ্রুত সম্ভব তারা এখান থেকে চলে যাবে। সব গোছগাছ করছে। ঘরে এসে রানু আর মাকে বললাম জরুরি প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ফেলতে। যে কোনো সময় এই এলাকা ছাড়তে হবে। ছোট মামা বলার পরই বেশির ভাগ গোছগাছ হয়ে গিয়েছিলো। এখন বাদবাকি জিনিসপত্র গোছানো শুরু করলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই মা আর রানু মিলে দুটো ব্যাগ গুছিয়ে ফেললো। আনুর কাপড়চোপর আর জিনিসপত্রেই একটা ব্যাগ ভরে গেলো। আমরা কেউ সামনের দুই রুমে যাওয়ার সাহস পাচ্ছিলাম না। আমি আসাদ ভাইকে বললাম, ‘বের হবো কী করে? গলির মাথায় গেলেই তো বড় রাস্তা, ওখানকার অবস্থা জানতে পারলে ভালো হতো। কোথায় কোন বিপদ ওৎ পেতে আছে কে জানে! এই অবস্থায় বাইরে নামা কি ঠিক হবে?’
ছোট মামা বললো, ‘নিজেদের তৈরি রাখতে হবে, সুযোগ বুঝে বেরিয়ে পড়তে হবে।’
সবাই পেছনের রুমে বসে ওখান থেকে বেরোনোর উপায় খুঁজছিলাম। এরমধ্যেই গোলাগুলি চলছিলো আর আমাদের উৎকণ্ঠাও ক্রমাগত বেড়েই চলছিলো। এভাবেই পেছনের রুমে বসে আমরা কেবল সময় গুনছিলাম। তবে সময় যেনো আর শেষ হচ্ছিল না। একেকটা মিনিটকে মনে হচ্ছিল ঘণ্টা। আনুমানিক রাত সাড়ে তিনটার মতো হবে, কিছুটা কমে এলো গোলাগুলির শব্দ। ঘরের পেছনে মৃদু শব্দ শুনে পেছনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি পাশের ঘরের ফারুক সাহেবরা বেরিয়ে এসেছেন।
মামাকে বলতেই সে বললো, ‘এটাই সুযোগ। চল এখনই বেরিয়ে পড়ি।’
আমি সায় জানালাম। মায়ের বড় ব্যাগ দেখে মামা ধমকে উঠলো। ‘এই ব্যাগ টানবো কে? এক কাপড়েই বেরিয়ে পড়তে হবে। শুধু সুরুজের বাচ্চার কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নাও।’
মা তবুও কাপড়চোপড় কিছু কমিয়ে ব্যাগটা নিজেই হাতে তুলে নিলেন। ঘরের পেছন দিক দিয়ে বেরুতে গিয়েই থমকে দাঁড়ালাম। পড়িমরি করে আমাদের দিকেই ছুটে আসছে ফারুক সাহেবরা। আমাদের ঘরের আলো নেভানোই ছিলো। সবাই ভেতরে চলে এলাম। একটু পর বাইরের অবস্থা জানার জন্য আমি আবারও ফারুক সাহেবদের জানালায় পাশে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরেই ফারুক সাহেব জানালার ওপাশে এলেন। আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ফিরে এলেন যে! ওদিকের অবস্থা কী খুব খারাপ?’
ফারুক সাহেব মাথা নাড়লেন। ‘এই গলির মাথায়ই গোলাগুলি চলছে। ভাই, সবদিকের অবস্থাই খারাপ। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ভাগ্যে যে কি আছে আল্লাহ্ই জানে।’
রানু মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদছিলো। আসাদ ভাই ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। রানুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, ‘চিন্তা করিস না, আল্লাহ বিপদ দিয়েছন, আবার আল্লাহই রক্ষা করবেন। আমার জান থাকতে তোর কিচ্ছু হইতে দিমু না।’
রানু ভাইয়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি পেলো। কান্না থামিয়ে মায়ের কাছ থেকে আনুকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, ‘আল্লাহ এই বিপদ থেকে আমাদের রক্ষা করো।’
মা রানুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
শঙ্কা, আতংক আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় আমরা নির্ঘুম রাতটা কোনরকমে পার করেছিলাম।
এস এম জাকির হোসেন
পল্লবী, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৩
চিরদিন প্রকাশনী
শীতল বাতাসে ঝরাপাতার গান
নিঃশব্দ চরাচরে হিমেল কাঁপুনি জাগে
কোলাহলবিহীন দীঘল রাতের নগরে
নামে কৃষ্ণপক্ষের নিস্তব্ধ আঁধার,
শিশির ছুঁয়ে যায় জোনাকির ডানা।
নিশুতি রাতের শেষে সকালের
স্বপ্নমাখা ঘুমটুকু কেড়ে নেয়
রোজকার প্রয়োজন; তখন-
তুষার সূর্যের লুকোচুরি খেলা শেষে
ধেয়ে আসে কুয়াশা প্রাচীর।
কচি হাতের উষ্ণ ছোঁয়ায়
তবুও জেগে থাকে প্রাণ- স্নেহ ভালবাসায়;
নাগরিক জীবনের অন্তহীন টানাপোড়েন,
কুয়াশার চাদর ঢাকে প্রলম্বিত চাঁদ।
নিঃসঙ্গ নদীর বুকে হিমশীতল নিরবতা
রাতের সুর কেটে যায় বৈরী শীতের তোপে,
উজানের অগাধ স্রোতে মিশে যায়
নিঃশব্দ রাতের বাতাসের কানাকানি।
লালনের গানে ঘোর লাগা ক্ষণ-
বাউল বাতাসে ভাসে একতারার সুর,
দোলে দোদুল মন- উদাসী হাওয়ায়;
পৌষী কোকিল ডেকে যায় শিমুলের ডালে।
হিম শীতল নীরব রাতের বিনিদ্র প্রহরে
পীচঢালা পথে কাঁপে জবুথবু পথচারী,
ছুটে চলে সুখী নীড়ে, ওম খোঁজে-
বিশ্বস্ত বন্ধনে; সুখের নিদ্রায়।
নিয়ন আলোর পৌষালি আবছায়ায়
ঘুমন্ত শহরে জেগে থাকে রাতের অপ্সরী,
মেলাতে চায় জীবনের না মেলা সমীকরণ;
উষ্ণতার খোঁজে আসে অচেনা পরজীবী।
ওম চাই, চাই আগুনের উষ্ণতা,
স্পর্শে জেগে ওঠে শীতল কোষ;
মাতাল রাতের প’রে মগ্ন আবেশে
মেঘের আড়ালে লুকায় মায়াবী চাঁদ,
দূরে অনন্ত আঁধার।
মোহাম্মদ মোকলেছুর রহমান: মহা বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলাম ই প্রথম মুসলিম বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালক।
চলচ্চিত্র অঙ্গনে মহা বিশ্বকবি’র সফলতা কতটুকু তা আজও অনেকের অনেকটা অজানা। চলচ্চিত্রে কাজী নজরুল ইসলাম এর উপস্থিতি একজন চিত্র পরিচালক, কাহিনীকার, সুরকার,গীতিকার ও অভিনেতা হিসেবে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমরা তাঁকে সঙ্গীতে যতখানি আবিষ্কার করতে পেরেছি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে ততখানি আবিষ্কার করতে পারি নাই।
কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম চিত্র জগতে আবির্ভূত হন ‘ধ্রুব ‘সিনেমার মাধ্যমে। গিরিশ চন্দ্রের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত পাইওনিয়ার ফিল্মসে’র এ সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন দুই জন। একজন কাজী নজরুল ইসলাম আরেকজন সত্যেন্দ্রনাথ দে। এ থেকে প্রমাণিত হয় কাজী নজরুল ইসলাম ই প্রথম বাঙালী মুসলিম চিত্র পরিচালক। কারণ এর আগে আর কোনো মুসলমানের নাম শোনা যায় নি চিত্র পরিচালক হিসেবে।
‘ধ্রুব ‘ সিনেমায় নজরুল ইসলাম ‘নারদ’ চরিত্রে অভিনয় করে সেকালের দর্শক সমাজকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছিলেন। তিনি ক্লিন সেভ অবস্থায় বাবরি চুল নিয়ে পাঞ্জাবি গায় দিয়ে পাতলা চাদর গলায় ঝুলিয়ে অভিনয় করেন। এ নিয়ে তাঁকে অনেক সমালোচনার শিকার হতে হয়েছিল। পৌরাণিক কাহিনী’র নেশায় মশগুল সেকালের মানুষ নজরুল ইসলাম এর এই নব-নারদী ভূমিকা কে যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারে নাই। নজরুল ইসলাম অবশ্য এ ব্যাপারে নিজ বক্তব্য রেখেছিলেন। ‘ ধ্রুব ‘ সিনেমার সুরকার ও ছিলেন তিনি। তাঁর দেয়া বৈশিষ্ট্যপূর্ণ গানের কথা ও সুরে আঙুর বালা গান গেয়েছিলেন। ‘ধ্রুব ‘মুক্তি পেয়েছিল ১৯৩৫ সালের ১ লা জানুয়ারীতে।
‘পাতালপুরী ‘(১৯৩৫) ছবিতে কাজী নজরুল ইসলাম কাহিনীকার শৈলজানন্দের অনুরোধে বিশেষ ধরনের গান রচনা করেন।সাঁওতালী আর ঝুমুর তাল মিশিয়ে তাতে বিভিন্নতার সমন্বয়ে নজরুল ইসলাম বিশেষ সঙ্গীত সৃষ্টি করলেন। এই গান ‘নজরুল ঝুমুর ‘নামে পরিচিত। এ সিনেমার আরেক গীতিকার ছিলেন শৈলজানন্দ।
এরপর ‘গ্রহের ফের’ ১৯৩৭’ ছবির সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব ও পালন করেন কাজী নজরুল ইসলাম।
১৯৩৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গোরা’ সিনেমায় তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত কে চলচ্চিত্রে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে ব্যবহার করেন।
১৯৩৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বিদ্যাপতি ‘ ছবির কাহিনীকার ও ছিলেন তিনি। তাঁর নাটক অবলম্বনে এ ছবি নির্মিত হয়।এ ছবির সুরকারও ছিলেন তিনি।
এরপর ‘সাপুড়ে’ (১৯৩৯) ছায়াছবির গান মহা বিশ্বকবি কে প্রচণ্ড খ্যাতি এনে দেয়
‘সাপুড়ে’ ছবির কাহিনী ও ছিল তাঁর ই।এই ছবির গান সে কালের মানুষদের মাতিয়ে তুলেছিলো। কানন দেবীর গান ” আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ঐ” অথবা বউ কসনে কথা কসনে ” গান আজও অনেকে স্মৃতিচারণ করে।
নজরুল ইসলাম ‘দিকশূল ‘ (১৯৪৩)
‘নন্দিনী (১৯৪০) ছবির জন্য গান লিখেন এবং চৌরঙ্গী (১৯৪২) ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন।
পরে কাজী নজরুল ইসলাম এর উৎসাহে শেরে-বাংলা, ‘আব্বাস উদ্দীন, ওস্তাদ খসরু নান্না মিয়া, সারোয়ার হোসেন প্রমূখ কে নিয়ে তৈরী হয় বেঙ্গল টাইগার পিকসার্স।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘মৃত্যু ক্ষুধা ‘উপন্যাস অবলম্বনে ‘মদিনা’ নামে একটি ছবির জন্য নজরুল ইসলাম গান ও লিখেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং কবির অসুস্থতার কারণে আর সে ছবি হয় নি।
নজরুল ইসলামের লেখা বিভিন্ন উপন্যাস, গল্প, গান নিয়ে ঢাকা – কোলকাতায় প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে অনেক সিনেমাই তৈরী হয়েছে।
কবি কুল শিরোমণি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে দীর্ঘ ১১ টি বছর জড়িত ছিলেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই শিল্পের কাজ করেন। কিন্তু সঠিক গবেষণার অভাবে তার চলচ্চিত্রে অবদানের বিশদ বর্ণনা আজও অনুদঘাটিত। মানুষ তেমন একটা জানতে ই পারেন নি যে, চলচ্চিত্রে ঠিক কি কি দিয়ে গেছেন মহা বিশ্বকবি কাজী নজরুল ইসলাম।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩১ সালে ছায়াছবির সাথে জড়িত হ’য়ে ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এ শিল্পের কাজ করেন। গবেষকদের মতে এই ১২ বছরে কাজী নজরুল ইসলাম ১৩ টি ছায়াচিত্রের সাথে জড়িত ছিলেন।
ছায়াচিত্রগুলো একনজরে —
১.ধ্রুব – ছায়াছবি ১৯৩৪ সালের ১ জানুয়ারীতে কলিকাতা ক্রাউন টকি হাউস -এ মুক্তি লাভ করে।
২.পাতালপুরী – ছায়াছবি ১৯৩৫ সালের ২৩ মার্চ কলিকাতা রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
৩.গ্রহের ফের – ছায়াচিত্র ১৯৩৭ সালের ৪ ডিসেম্বর কলিকাতা রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
৪.বিদ্যাপতি (বাংলা) – ছায়াচিত্র ১৯৩৮ সালের ২ এপ্রিল কলিকাতা চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
৫.বিদ্যাপতি (হিন্দি)- ছায়াচিত্র ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বোম্বে ও করাচীতে মুক্তি লাভ করে।
৬.গোরা – ছায়াচিত্র ১৯৩৮ সালের ৩০ জুলাই কলিকাতা চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
৭.সাপুড়ে – ছায়াচিত্র ১৯৩৯ সালের ২৭ মনে কলিকাতা পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
৮.সাপেড়া (হিন্দি) – (তথ্যঃ সবারে আমি নমি, পৃষ্ঠা ৬০। পরে আলোচিত।)
৯.নন্দিনী -ছায়াচিত্র ১৯৪১ সালের ৮ নভেম্বর কলিকাতা রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
১০.চৌরঙ্গী (হিন্দি) -ছায়াচিত্র ১৯৪২ সালের ৪ জুলাই কলিকাতায় মুক্তি লাভ করে।
১১.চৌরঙ্গী (বাংলা) ছায়াচিত্র ১৯৪২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর কলিকাতা রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি লাভ করে।
১২.দিকশূল -ছায়াচিত্র ১৯৪৩ সালের ১২ আগষ্ট কলিকাতায় একযোগে মিনার,বিজলী ও ছবিঘর প্রেক্ষাগৃহগুলিতে মুক্তি লাভ করে।
১৩.অভিনয় নয় – ছায়াচিত্র ১৯৪৫ সালের ২ মার্চ কলিকাতা রূপবাণী প্রেক্ষাগৃহে মুক্তিলাভ করে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় কবি নজরুল ইসলাম আরো কিছু ছায়াছবির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। যেমন –
১. ধ্রুবঃ পায়োনিয়ার ফিল্মস দ্বারা পরিবেশিত। কাহিনী রচনা করেন নাট্যকার গিরীশ চন্দ্র ঘোষ। কবি নজরুল ইসলাম এ ছায়াচিত্রের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করা ছাড়াও ছায়াচিত্রের গীত রচনা, সুর সংযোজন, সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পালন, ছায়াচিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয় এবং নারদের কন্ঠে ৪ টি গানে অংশগ্রহণ করেন। কবি একক কন্ঠে তিনটি গান এবং দ্বৈত কন্ঠে মাষ্টার প্রবোধের সঙ্গে একটি গান করেন। শিল্পী আঙ্গুর বালা একক কন্ঠে চারটি ও মাষ্টার প্রবোধের সঙ্গে দ্বৈত কন্ঠে একটি গান করেন। মাষ্টার প্রবোধ একক কন্ঠে ছয়টি গান করে। শিল্পী পারুল বালা একক কন্ঠে দু’টি গান করেন। এই মোট ১৭ টি গান কবি কাজী নজরুল ইসলাম দ্বারা রচিত এবং সুরারোপিত। এই ছায়াচিত্রে মোট গানের সংখ্যা আঠারোটি। বাকী গানটি রচনা করেন নাট্যকার গিরীশ চন্দ্র ঘোষ। সুরারোপ কবি নজরুল ইসলামের।

কবি নজরুল ইসলাম পায়োনিয়ার ফিল্মস্ কোম্পানিতে ১৯৩১ সালে যোগদান করেন।ফিল্ম কোম্পানির গীত রচনা, সুর সংযোজন ইত্যাদি করার পাশাপাশি তিনি দশটি গ্রামোফোন কোম্পানিতে গীত রচনা, সুর সংযোজন ও প্রশিক্ষণের দায়-দায়িত্ব ও পালন করতেন।
কবি নজরুলের চলচ্চিত্র ও গান যেমন তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেন, ঠিক তেমনি এক শ্রেণীর কট্টর মুসলমান কর্তৃক চরম নিন্দিত ও হতে থাকেন।তাদের মতে ইসলামে সঙ্গীত হারাম না হলেও বাংলার মুসলমানেরা গান-বাজনা হারাম মনে করতো। নজরুল ইসলামের ইসলামী গান তাদের সেই ভুল ধারণা দূর করে দেয়।
মহান রাব্বুল আলামিন এই বিশাল মানুষটিকে জান্নাত দান করুন।
রেফারেন্সঃ
১.আসাদুল হক, দৈনিক মিল্লাত ২৫/১১/৯৩।
২.অনুপম হায়াত, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, পৃষ্ঠা ২২,২৩,২৪।
৩.দৈনিক ইনকিলাব, ৮/১২/১৯৯৭।
৪.সবারে আমি নমি,কানন বালা।
এবং যাহারা বাঁচিয়া থাকিবে
পানি পাবে ফের হালে,
আবার আসিবে মহামারি কোনো,
২১২০ সালে।
যাহারা রহিলো আপনালয়ে
তাহারা বাঁচিবে শেষে ,
মন্দ মানুষও বাঁচিয়া রহিবে
তৃপ্তির হাসি হেসে।
এবং মরিবে মন্দ মানুষ
উত্তম কোনো লোক,
অবশেষে সবে,খুশিতে মাতিবে
ঘুচিবে দুঃখ,শোক।
মন্দ মরিবে মনে করে কেহ
উত্তম কেন হায়!
ভালো লোকে রুখিলে মন্দ
কেমন করিয়া হয়?
রেহাই পাবেনা কেহই, কারণ
সবারই সমান দোষ,
মন্দ কর্ম প্রশ্রয় দেয়,
ভাব ধরে নির্দোষ ।
এক সন্ত্রাসী সন্ত্রাস করে
শত লোকে চেয়ে দেখে,
এক সন্ত্রাসী প্রশ্রয় পায়,
শত সন্ত্রাসী শেখে।
সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘু
সৎলোক ঢের বেশী,
সবাই মিলিয়া চাপিয়া ধরিলে
বাঁচিবে কি সন্ত্রাসী?
দাপট কারো রয়না ভবে
চিরকাল,চিরদিন,
আজিকে সবাই হাহাকার করে
সবারই তো দুর্দিন।
মিন্টু রহমান: কাজী নজরুল ইসলামেরর সৃষ্টিকর্ম অধ্যয়ন করে পরিস্কার বুঝতে পেরেছি যে তিনি শুধু বাংলা ভাষা-সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবি নয়— সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি।
তিনি দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, প্রকৃতির কবি, জাগরণের কবি।
বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরনে তাঁর অবদান অবিস্মরনীয়, আরবী-ফার্সী-হিন্দী-উর্দু-সংস্কৃতি-ইংরেজী ইত্যাদির ভাষার সমন্বয়ে কবিতা-গদ্য ও গান রচনা এর সত্যতা প্রমাণ করে। এমনকি তাঁর Philosophy (দর্শন) “মানবতাবাদ” এর শ্রেষ্ঠত্বের পক্ষে যুক্তি বা প্রমাণ হিসাবে উন্নত শির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং চিরকাল রইবে।
অসাম্প্রদায়িকতা,সহ অবস্থান, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের কথা অন্য কোন কবি-সাহিত্যিক নির্ভয়ে উচ্চারণ করেতে সাহস করেনি—এমনকি বৃটিশ শাসিত ভারত বর্ষের দুটি বৃহৎ সম্প্রদায় যথা হিন্দু ও মুসলমানেরর কথা মুখে বা লেখায় বলতে বা আনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেনি অথবা বৃটিশ বিরোধী লেখালেখি বা অন্যায়-অত্যাচার,শোষনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে কলম ধরেনি।
তাঁর লেখা কৃষক-শ্রমিক, মুটে-মজুর,কামার-কুমার, তাতী-জোলা,ধীবক(জেলে) সহ সকল পেশাজীবি মানুষের পক্ষে নিবেদিত হয়েছে-অথচ যা অন্য কোন বাঙালী কবির লেখনিতে এক কলমও পাওয়া যায়না।

পৃথিবীতে এমন নজীর নাই যে কোন কবি-সাহিত্যিক নিজের দেশর স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন করতে গিয়ে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড ও বিভিন্ন সময়ে জেল খেটেছেন— কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম একমাত্র কবি যে তা করেছেন, যদিও ১৯০০ সালে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী তাঁর কাব্যগ্রন্থ “অনল প্রবাহ” রচনার কারনে গ্রেফতার হয়েছিলেন- এবং শুধুমাত্র তাঁর কারাদন্ড হয়।
তাঁর রচিত সংগীত সংখ্যায় বিশাল যা বৈচিত্র্যপূর্ণ বলা হয়- নানা রকমের রং-ঢং ,শব্দ-তাল-লয়,রাগ-রাগিনীর ব্যবহার ভারতীয় মার্গ সংগীতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করন লক্ষ্যনীয়।
পদ্য ও গদ্য সাহিত্যে ছ্দ, উপমা-উৎপ্রেক্ষা-রূপক ও চিত্রকল্প ব্যবহার নিঃসন্দেহে অতুলনীয়, বিষেশ করে ছন্দের অপরূপ ব্যবহার ও চিত্রকল্পের প্রয়োগ তাঁকে ছন্দের যাদুকরী এবং চিত্রকল্পের রাজা বলতে হয়।গল্প, নাটক, উপন্যাসপেক প্লট তৈরীতে তিনি নিপুন হস্তের অধিকারী ছিলেন,এমনকি প্রবন্ধ এ চিঠিপত্রে তাঁর ভাষা ও শব্দ ব্যবহার চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে।
তাঁর রচিত সংগীত সংখ্যায় বিশাল যা বৈচিত্র্যপূর্ণ বলা হয়- নানা রকমের রং-ঢং ,শব্দ-তাল-লয়,রাগ-রাগিনীর ব্যবহার ভারতীয় মার্গ সংগীতের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ করন লক্ষ্যনীয়।
এজন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “give up hunger strike, our literature claims you”
সবশেষে সংক্ষিপ্ত বলতে হয় যে, শুধুমাত্র একটি কবিতা “বিদ্রোহী”র নাম উল্লেখ করলেই কাজী নজরুল ইসলামকে নিঃসন্দেহে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কবি বলা যেতে পারে-যে কবিতার শতবর্ষ উদযাপন চলছে এখনো ।উল্লেখ্য যে কোন কবিতার শতবর্ষ উদযাপিত আর হতে শোনা যায়নি বা হয়নি।
কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা রাজনৈতিক দল নিজের পছন্দ বা খুশী মতো কাউকে বিশেষ খেতাব/বিশেষনে ভুষিত করতেই পারে, তবে অবশ্যই কোন ব্যক্তি,দেশ, জাতি়,গোষ্ঠী তা গ্রহণ নাও করতে পারে—তা নিজেদের ইচ্ছা বা নিতান্তই নিজস্ব ব্যপার এবং পেছন দিক থেকে এসে ষড়যন্ত্র করে গায়ের জোরে চাপিয়ে দেয়া মোটেও ঠিক নয়।
লেখকঃ জনাব মিন্টু রহমান, সাধারন সম্পাদক, নজরুল একাডেমী, ঢাকা।